নিজস্ব প্রতিবেদক: দুনীতি দমন কমিশনে (দুদক) ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ কম জমা পড়েছে। অনুসন্ধানের জন্য বেছে নেয়া অভিযোগের পরিমাণও কমেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
রোববার (২০ মার্চ) বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কমিশনের ‘বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০ ও ২০২১’পেশ করে। প্রতিনিধিদলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক ও দুদক সচিব মাহবুব হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেল (যাচাই-বাছাই কমিটি) ২০২০ সালে ১৮,৪৮৯টি অভিযোগ বাছাই করে ৮২২টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে। বাকি ২৪৬৯টি অভিযোগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছে। ২০২১ সালে ১৪,৭৮৯টি অভিযোগ থেকে ৫৩৩টি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি ২৮৮৯টি অভিযোগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
কমিশনের বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কমিশনের সাফল্য অব্যাহত রয়েছে দাবি করে বলা হয়, ২০২০ সালে নিম্ন আদালতে দুদক ও বিলুপ্ত ব্যুরোর (দুর্নীতি দমন ব্যুরো) মোট বিচারাধীন ৩,৩৮২টি মামলার মধ্যে ১৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে ১২১টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৭২% এবং বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৪৮% অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৬৮.৭৫%। আবার ২০২১ সালে মোট ৩,৪৩৪টি মামলার মধ্যে ২০৩টির নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে ১১৯টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৬০% এবং বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৩০% অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৫৮.৬২%।
কমিশনের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ২০১৯ সাল থেকে সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। কভিড-২০১৯ এর কারণে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় অভিযান পরিচালনা কম হলেও এ ইউনিটের মাধ্যমে ২০২০ সালে ৪৮৭টি এবং ২০২১ সালে ২৪৫টি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে গোয়েন্দা ইউনিট কমিশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে। ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ৬৬৫টি অভিযোগ গোপনে তথ্যানুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়, যার মধ্যে ২৫০টির নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ৪১৫টি অভিযোগের গোপন তথ্যানুসন্ধান চলমান রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানের পর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে ১৫৪টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে কমিশনের স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট যাত্রা শুরু করে। ওই ইউনিটের অধীনে ২০২০ সালে আদালতের আদেশে ১৮০,১১,৯১,৭৪৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক ও ১৫২,৯২,৮৬,৪৯৬ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ২০২১ সালে ৩২৬,৭১,৪৬,৬২৮ টাকার সম্পত্তি ক্রোক ও ১১৬১,৫৮,১৪,৪৮০ টাকার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার) অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
কমিশনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এমনকি কঠোর লকডাউনকালেও অনলাইনে পিপিএ ও পিপিআর-এর ওপর ৭৯ জন প্রশিক্ষণার্থীর ১৫ দিনের সিপিটিইউ এর ফ্ল্যাগশিপ প্রশিক্ষণসহ আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত বিট কয়েন, ক্রিপ্টো কারেন্সি, ই-মেইল,হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে অনলাইনে প্রশিক্ষণ হয়েছে। এছাড়া অফিস ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, শুদ্ধাচারসহ নানা বিষয়ে ৮ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের লক্ষ্যে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করে কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কমিশনের বিদ্যমান জনবল কাঠামো যৌক্তিক করার জন্য কমিশনের মহাপরিচালক (মানিলন্ডারিং)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের জন্য নিজস্ব আধুনিক ভবন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কমিশনের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় গত ১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা কার্যালয় কাজ শুরু করেছে। আগামী জুলাই মাসে আরো ১৩টি জেলা কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান জনবল পূরণের অংশ হিসেবে ১৩২ জন সহকারী পরিচালক ও ১৪৭ জন উপসহকারী পরিচালক নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। এছাড়া অন্যান্য পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
২০২০ সালে ছয়জন উপসহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী পরিচালক করা হয়েছে। নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালে ৩৪ জন সহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে উপপরিচালক, ৪৫ জন উপসহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী পরিচালক ও পাঁচ জন সাঁটলিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটরকে উপসহকারী পরিচালক পদে উন্নীত করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন ও বিধিমালা যুগোপযোগী করে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য কমিশনের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৯(১) ধারা মোতাবেক দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবছর পেশ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক অতিমারি কভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাব ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২০ সালের প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় এ বছর ২০২০ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন একত্রে প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালের জন্য প্রণীত এ প্রতিবেদনে কমিশনের কার্য-সম্পাদন, সম্পাদিত কাজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জবাবদিহিতা এবং সরকার প্রদত্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত তথ্যসহ কমিশনের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।