আমিনুল ইসলাম সোহেল: সকালে দিনের প্রথম কাজ দুধ দোহন ও তার পরপরই শীতলীকরণ কেন্দ্রে সরবরাহ করা। গাভির জন্য খাবার তৈরি ও খাওয়ানো, সময়মতো গোসল করানো, বিকালে ফের দুধ দোহন করে শীতলীকরণ কেন্দ্রে সরবরাহ। অসুখ-বিসুখ হয়েছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। কোনো রোগে আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করাÑএসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় কাশিমপুর গ্রামের প্রায় দুইশ দুগ্ধখামারিকে।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার গ্রাম কাশিমপুর। উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে এ গ্রামের চিত্র কিছুদিন আগেও ছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের জেলেপাড়ার মতো নিষ্প্রাণ। সেখানকার মানুষও ভাবতো, ঈশ্বর এ গ্রামে থাকেন না, ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে। সেই ঈশ্বরই হয়তো তাদের প্রতি সদয় হয়েছেন, শিখিয়েছেন কীভাবে সফল হওয়া যায়। গাভি পালন করে এ গ্রামের প্রায় দুইশ মানুষ লাখপতি হয়েছে। সে সঙ্গে কাশিমপুর পরিচিতি পেয়েছে ‘দুধের গ্রাম’ হিসেবে।
গ্রামের ইউনুস আলী প্রতিবেশী একজনের বাড়িতে রাখালের কাজ করে বড় হয়েছেন। খাওয়া-দাওয়া, পোশাকসহ বছর শেষে কিছু টাকাও পেতেন। কয়েক বছরের জমানো টাকায় একটি গাভি কেনেন। সেটা ২০০৫ সালের কথা। সে সময় উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে গ্রামে গ্রামে উন্নত জাতের গাভি পালনে প্রচার চালানো হয়। তাতে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে গাভিটি কেনেন। অবশ্য কিছুদিন পর রোগে ভুগে গাভিটি মারা যায়। এতে তিনি কষ্ট পেলেও দমে যাননি; বরং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন গাভি পালনে। এরপর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কৃত্রিম প্রজননের একটি গাভি কেনেন।
সেই শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একে একে তার গোয়ালে এখন আটটি গাভি, বাছুর আছে পাঁচটি। প্রতিটি গাভির দাম দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেখাশোনা করেন। ইউনুস আলী প্রতিদিন গড়ে ১২০ লিটার দুধ বিক্রি করেন। গড়ে ৪০ টাকা দরে প্রতিদিন আয় করেন প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। এর অর্ধেক খরচ হয় গরুর খাবার, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে।
দিনমজুর রফিকুল ইসলামও ইউনুস আলীর সঙ্গে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাভি কেনেন। তিনি এখন আটটি গাভি ও আটটি বাছুরের মালিক। দিন শেষে আড়াই হাজার টাকা পকেটে থাকে তার।
যত সহজে দুজনের গল্প বললাম, বিষয়টা তত সহজ নয়। ২০০৫ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দুইশ গাভির খামার গড়ে উঠেছে কাশিমপুরে। সব মিলিয়ে গ্রামে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। প্রথম দিকে ব্র্যাকের আড়ং দুধ কোম্পানি তাদের কাছ থেকে দুধ কিনতো। তবে অনেক খামারি অভিযোগ করেন, আড়ং দুধের ন্যায্য মূল্য দিত না।
আড়ং দুধের লরি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা উপজেলা সদরের ব্র্যাক সেন্টারের সামনে দাঁড়াতো। খামারিরা চার কিলোমিটার দূরের সেই সেন্টারে দুধ পৌঁছে দিয়ে আসতেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট পর গেলে আড়ং দুধ নিত না। প্রতিদিন অনেক খামারি দুধ নিয়ে তাই ঝামেলায় পড়তেন। উপায় না থাকায় কম দামে মিষ্টির দোকান ও রেস্তোরাঁয় দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হতেন খামারিরা। এতে তাদের অনেক লোকসান হতো।
লোকসান দিতে দিতে খামারি আশরাফুল ইসলামের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভাবতে থাকেন, কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। একসময় সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই দুধ শীতলীকরণের কারখানা স্থাপন করবেন। যে চিন্তা, সেই কাজ। পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে দুবছর আগে স্থাপন করেন দুধ শীতলীকরণ কারখানা। এতে অন্যদের উপকার হলেও খামারির তালিকা থেকে তার নাম মুছে যায়। খামারে সময় দিতে না পারায় তিনি বাধ্য হয়ে সব গাভি বিক্রি করে দেন। এজন্য তার মনে চাপা কষ্ট রয়েছে। তারপরও অন্য খামারির কষ্ট দূর করতে পেরে তিনি তৃপ্ত।
তিনি শীতলীকরণ করে মিল্ক ভিটা ও আড়ংয়ের কাছে দুধ বিক্রি করেন। পরে আড়ং কর্তৃপক্ষও কাশিমপুরে শীতলীকরণ কারখানা স্থাপন করে। পাশাপাশি আরও একটি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে গ্রামে। এখন আর খামারিদের দুধ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না কিংবা দূরে যেতে হয় না। তারা এখন সকাল-বিকাল শীতলীকরণ কেন্দ্রে দুধ বিক্রি করতে পারেন।
শীতলীকরণ কেন্দ্রে দুধে ননির পরিমাণও পরিমাপ করা হয়। যার দুধে ননির পরিমাণ বেশি, তিনি বেশি দাম পেয়ে থাকেন। সাত দিনের দুধ ও ননির পরিমাণ হিসাব করে টাকা পরিশোধ করা হয়। হিসাব রাখার জন্য প্রত্যেক খামারির নিজস্ব খাতা আছে। দুধে ননির পরিমাপ করে সঠিক দাম লিখে দেওয়া হয় তাতে।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সেই জেলেপল্লির চিত্র এখন অতীত কাশিমপুরে। কয়েক বছরে বদলে গেছে দৃশ্যপট। কাশিমপুর এখন দুগ্ধখামারিদের গ্রাম। কাশিমপুর এখন দুধের গ্রাম।