নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: দেশের জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও শ্রমিকের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। ফলে প্রতি বছর কোনো কোনো ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা আহত ও নিহতের শিকার হোন। গত এক দশকে চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডগুলোয় ১৪২ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। আর ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পায়। কিন্তু কোনো ইয়ার্ডে কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় না। এমন কি মালিকরা শাস্তি পান না। এসব ঘটনায় তেমন মামলাও হয় না।
বেসরকারি একটি সংস্থার গবেষণা বলছে, গেল এক দশক ধরেই এই মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগ জাগানিয়া। জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম সূত্রে জানা যায়, জাহাজ ভাঙার কাজে ২০১৪ সালে ৯, ২০১৫ সালে ১৬, ২০১৬ সালে ১৭, ২০১৭ সালে ১৫, ২০১৮ সালে ২০, ২০১৯ সালে ২২, ২০২০ সালে ১১, ২০২১ সালে ১৪, ২০২২ সালে ১০, ২০২৩ সালে ৮, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুজন মারা গেছে। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে সীতাকুণ্ডে এসএন করপোরেশনের শিপ ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার সময় বিস্ফোরণে ১২ জন দগ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। এখনও বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অথচ এ গ্রিন শিপইয়ার্ড সনদপ্রাপ্ত ইয়ার্ডে ইতিহাসে বড় দুর্ঘটনা ঘটল। এক্ষেত্রে সরকারি এবং আন্তর্জাতিক নানা তৎপরতার পরেও এসব ইয়ার্ডে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না।
সম্প্রতি এস এন করপোরেশনের গ্রিনশিপ ইয়ার্ডে বিস্ফোরণে আবারও নড়েচড়ে বসেছে সবাই। কারণ হংকং কনভেনশন অনুযায়ী, এই ইয়ার্ডটি প্রতি বছরই নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তদারকির ভেতরে থাকে। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এই দুর্ঘটনার ফলে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের পরিবেশগত ছাড়পত্রের কয়েকটি শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। একইভাবে, স্ক্র্যাপ জাহাজের ছাড়পত্রের শর্তাবলিও ভঙ্গ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এস এন করপোরেশন (ইউনিট-২) এবং এমটি স্বরাজ্য স্ক্র্যাপ জাহাজের পরিবেশগত ছাড়পত্র স্থগিত করা হয়েছে এবং শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নির্দেশে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় এস এন করপোরেশন (ইউনিট-২) ও এমটি স্বরাজ্য স্ক্র্যাপ জাহাজের পরিবেশগত ছাড়পত্র স্থগিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত স্বরাজ্য স্ক্র্যাপ জাহাজের শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে।
জানা যায়, নিবিড় শ্রমসাধ্য এবং বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক কাজের একটি শিপ ব্রেকিং বা পুরোনো জাহাজ ভাঙা। দেশের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে প্রতিনিয়ত আগুন, বিস্ফোরণ, পিছলে পড়ে কিংবা বড় লোহার পাতের নিচে চাপা পড়ে মারা যান শ্রমিকরা। এসব ক্ষত্রিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসারে লস অফ ইয়ার আর্নিং এবং সাফারিং বিবেচনায় নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আহত বা নিহতের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে কথা উল্লেখ আছে। আর দেশের শ্রম আইনের ধারা ১৫১ এবং পঞ্চম তফসিলের ২য় কলামে উল্লেখ আছে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া জাহাজভাঙা পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালার ৪৫.৩ বিধিতে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা উল্লেখ আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, সেসব উদ্ঘাটনে খুব বেশি তৎপরতা নেই কারও। অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র শ্রমিকদের পরিবারকে বুঝিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। ফলে কাগজে কলমে নানা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছে, শ্রমিকদের মৃত্যু বন্ধে বহুপক্ষীয় গাফিলতি আছে। যদিও সেটি অস্বীকার করছে এই শিল্পের মালিকপক্ষ।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত বলেন, এস এন করপোরেশনের ইয়ার্ডে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় ১২ জন শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়েছেন। এরমধ্যে ছয়জনের শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আশঙ্কাজনকভাবে আহত ছয়জন শ্রমিককে ইতোমধ্যে আইসিউতে ভর্তি করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনা স্মরণ কালের ভয়াবহতম দুর্ঘটনা। এ ধরনের দুর্ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেনি এবং সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দুর্ঘটনা ঘটেছে এস এন করপোরেশন গ্রিনশিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। গ্রিনশিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রমাণ করে শিপ ব্রেকিং সেক্টরে এখনো নিরাপদ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তারা বলেন, গত ৩ জুলাই ফোর স্টারশিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় চারজন শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়েছিল। তখন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শন রিপোর্টে মালিক পক্ষের সুস্পষ্ট ত্রুটি ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও ফোর স্টারশিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।
জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে নিয়ে কাজ করেন ফজলুল কবির শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিবার দুর্ঘটনা হয়, তদন্ত কমিটি আসে। কিন্তু সঠিক কারণটি উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। এখন সঠিক কারণ উদ্ঘাটন না গেলে কীভাবে সমস্যা সমাধান করা হবে। আর শ্রমিকদের যুগোপযোগী ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। যদিও আইনে অনেক কম ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে। তা অবশ্যই পায়। কিন্তু কোনো মালিকের শাস্তি হয়নি। এমন কি কোনো ইয়ার্ড বন্ধ হয়নি। হলেও সাময়িক বন্ধ হয়।
কয়েকজন ইয়ার্ড মালিক বলছেন, এই শিল্পে সুরক্ষা খাতে বাংলাদেশ আশপাশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, তা কমিয়ে আনতে নানা চেষ্টা চলছে। কোনো ইয়ার্ড মালিক শ্রমিকের মৃত্যু কামনা করে না। এখনও মূলত সর্তকতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। একটি অসতর্ক হলেও বিপদ। তাই এতো আলোচনা হচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসএন করপোরেশনের দুর্ঘটনা নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
উল্লেখ, বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আছে ১৭৯টি। তবে বর্তমানে চালু আছে ৩০-৩৫টি। যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের গ্রিনশিপ ইয়ার্ডের সংখ্যা চারটি।