সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোয় আগুন লাগার পর চট্টগ্রামবাসী যেভাবে উদারতা ও মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা দেখে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ গানের কথা মনে পড়ে। সীতাকুণ্ড অগ্নিদুর্ঘটনার পর মধ্যরাতেও সাধারণ মানুষ যেভাবে রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতালে ছুটে গেছেন, তা সত্যিই অভাবনীয়। এ ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করে, আবার চরমভাবে ব্যথিত করে এটা ভেবে যে, এতগুলো নিরীহ প্রাণ ঝরে গেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জন্য!
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো দাহ্য বস্তু কোনো রকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই মজুূত করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাসায়নিক থাকলেও তাদের জানানো হয়নি। এমনকি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাখার জন্য যে বিশেষ ধরনের অবকাঠামো ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত ছিল, তাও করা হয়নি। ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জন মৃত্যুবরণ করেন, আহত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ৯০০ কোটি টাকার ওপরে। সেইসঙ্গে এলাকার পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।
বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবারই প্রথম নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং চরম উদাসীনতা। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন মারা যান, আহত হন ২০০ জন। অথচ এ ঘটনায় কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন মারা যান। আগুন লাগার এরকম প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ/ডিপো কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় সঠিক বিচার পাওয়া সম্ভব হয় না।
১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পুনর্গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭ দমকল কর্মী মারা গেছেন, যার মধ্যে সীতাকুণ্ডে ৯ জন দমকল কর্মী নিহত হন। বাংলাদেশে একসঙ্গে এত দমকল কর্মীর প্রাণহানি আর কখনোই ঘটেনি। সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বাস্তবতায় আরেকটি বিষয় সামনে চলে আসছে, তা হলো এ দেশের ফায়ার সার্ভিসের জন্য উন্নত ও আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু তাদের বহরে এখনও উন্নত ও আধুনিক সরঞ্জাম নেই। তাদের বহরে হেলিকপ্টার, উচ্চতাসম্পন্ন ইমার্জেন্সি মই ও আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করতে হবে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় এ বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে অসংখ্য মায়ের বুক খালি হয়ে গেল; কারও বন্ধু, কারও ভাই, কারও স্বামী এবং কারও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিও অকালে এ করুণ মৃত্যুর শিকার হলো। মালিকের অসাবধানতা বা অতি মুনাফালোভী মানসিকতার জন্য আজ এতজন মানুষকে বিভীষিকাময় অকাল মৃত্যুর শিকার হতে হলো। সরকারকে অবশ্যই সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত এবং আহত পরিবারগুলোর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে পরিবারে কর্মক্ষম কোনো সদস্য থাকলে তাদের চাকরির ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
নিমতলী কিংবা তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের চেয়েও সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আরও ভয়াবহ এ কারণে যে, ডিপো কর্তৃপক্ষ দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো রকম অনুমোদনই নেয়নি। এমনকি জনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় এরকম ডিপো পরিচালনা করা কতটুকুই যৌক্তিক, সে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো কোম্পানিকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদনের অনুমতিই দেয়া হয়নি, সেখানে রপ্তানি করা অনেক আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
অথচ দেখুন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি থেকে শুরু করে, তাজরিন ফ্যাশন, নিমতলী ট্র্যাজেডি, কিংবা সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিÑপ্রতিটি জাতীয় দুর্যোগে সাধারণ মানুষ নিজের সর্বোচ্চটুকু নিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু যাদের অবহেলায় ও উদাসীনতায় বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, তাদের কি আমরা প্রকৃত বিচারের আওতায় আনতে পেরেছি? শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠ পরিবেশ কি আমরা দিতে পেরেছি? এভাবে আর কতদিন? রাষ্ট্র তুমি কার? মৃত শ্রমিকের সন্তানের আর্তনাদ কি তুমি শুনতে পাও না?
তানভীর আহমেদ
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ