অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের কিছু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব, অবকাঠামোগত সমস্যা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়া, অর্থ পাচার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে দেশের সাধারণ মানুষের মতে, এসব নয়; দুর্নীতির ব্যাপকতাই উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বুধবার বিশ্বব্যাপী একযোগে যে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন (জিসিআর) ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক (জিসিআই) প্রকাশ করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের এ ধারণা দৃঢ়ভাবে স্বীকৃত হয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জরিপ পরিচালনা করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এবং ১০ কোটি টাকার বেশি মূলধন আছেÑএমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের কাছে জরিপের প্রশ্ন দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতেই তৈরি হয় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৮। রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউইএফের পক্ষে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়ে আরেকটি ত্বরিত মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিপিডি।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনে (জিসিআর) বলা হয়েছে দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও অবকাঠামো সমস্যার কারণে জিসিআইয়ে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়েছে। বিশ্বের ১৪০ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১০৩। আগেরবার এটা ছিল ১৩৫ দেশের মধ্যে ১০২। আগের তুলনায় কিছুটা ভালো করলেও অন্য দেশগুলো বেশি ভালো করায় সার্বিক বিবেচনায় পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, সহজে ব্যবসা পরিচালনার (ইজ ডুয়িং বিজনেস) ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব নেতিবাচক কারণের মধ্যে দুর্নীতিই বড়। অন্য প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, দক্ষ কর্মীর অভাব, দুর্বল শ্রম আইন, অর্থের জোগানে সমস্যা, অস্থিতিশীল ব্যবসায়িক নীতি, প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব প্রভৃতি। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই বলেছেন, অর্থ পাচার বেড়েছে এবং দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগামী নির্বাচনের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চারটি খাতে প্রভাব পড়বে। এগুলো হলো পণ্য উৎপাদন, রফতানি, কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স।
ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা উচিত বলে মত দিয়েছেন। এটিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমস্যা অবকাঠামো। সরকার বিচ্ছিন্নভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করলেও এগুলো ব্যবসাবান্ধব নয়। জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শ্রমিক, স্বল্প সুদে ঋণ ও বন্দর প্রভৃতি বহুমুখী সুবিধাসংবলিত অবকাঠামো নেই। আবার বিদ্যমান অবকাঠামো খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার পুরো সুবিধা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। লক্ষণীয়, প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত। এটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে সরকারকে। বহির্বিশ্বে এ বার্তা যেতে পারে যে, গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীন থাকলে দুর্নীতি এত ব্যাপক রূপ নিত না বা ‘স্বাধীনতা সীমিত’ বলে দুর্নীতির সব খবর গণমাধ্যমে সেভাবে প্রকাশও হয় না। দুটোই সরকারের জন্য বিব্রতকর।
ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতেও সমস্যার কথা সবার জানা। এ খাতে সুশাসন ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে (জিসিআই) নিচের দিকে থাকায় দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে, তা হয়তো নয়। তবে দুর্নীতি নির্মূল ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলে দেশ এগিয়ে যাবে তা স্বীকার করবে সবাই।