দুর্নীতি নির্মূলে তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে

 

ইমদাদ ইসলাম: গাইবান্ধার মোস্তাইন বিল্লাহ মানিক ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৮(১) ধারা অনুসারে সহকারী প্রকৌশলী (বিএডিসি) ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), উপজেলা সেচ কমিটি; সুন্দরগঞ্জ, জেলা বিএডিসি (সেচ) অফিস, গাইবান্ধা বরাবর নিম্নলিখিত তথ্য চেয়ে আবেদন করেনÑ

(ক) মো. বকুল মিয়া, পিতা-মৃত নুরুল হক, গ্রাম: পূর্ব বেলকা, উপজেলা- সুন্দরগঞ্জ, জেলা-গাইবান্ধাকে ১৬৯২ নম্বর সেচ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য তিনি কত তারিখে আবেদন করেছিলেন? উপজেলা পরিষদ কর্তৃক উক্ত আবেদন কত তারিখে কোন পত্রের আলোকে সভাপতি, উপজেলা সেচ কমিটির নিকট প্রেরণ করেছেন? সভাপতি মহোদয় উক্ত আবেদন কত তারিখে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেছিলেন? উক্ত আবেদনপত্রের দলিলাদিসহ উহার তথ্যাদি (খ) সেচ নীতিমালা অনুযায়ী একটি সেচ লাইসেন্সের আবেদন বিধি মোতাবেক না হওয়ার কারণে বা আবেদনকারী জালিয়াতির মাধ্যমে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলে উক্ত আবেদন/লাইসেন্স বাতিল না করে সংশোধন করা যায় কি না? উহার তথ্যাদি (গ) সেচ নীতিমালা অনুযায়ী একটি অগভীর নলকূপ হতে অন্য একটি অগভীর নলকূপের দূরত্ব কত ফিট? উক্ত নলকূপের আওতাধীন কত বিঘা আবাদি জমি থাকতে হয় (ঘ) বিগত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ও ০৩ মার্চ ২০২২ উপজেলা সেচ কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত/ বাতিলকৃত/ পুনঃতদন্তের আবেদনের তালিকা ও রেজুলেশন (ঙ) ১০ ফেব্রুয়ারি  ২০২২ তারিখ হইতে অদ্যবধি পর্যন্ত গৃহীত সেচ লাইসেন্সের আবেদন সমূহের এন্ট্রি রেজিস্টারের ফটোকপি (চ) লাইসেন্স প্রদান রেজিস্ট্রারের ১৯৩০ ও ১৯৩১ নম্বর সেচ লাইসেন্সের সরবরাহকৃত রেজিস্টারের ফটোকপি।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাহিত তথ্য না পেয়ে অভিযোগকারী ১৩ এপ্রিল ২০২৩ সদস্য সচিব ও আপিল কর্তৃপক্ষ, নির্বাহী প্রকৌশলী, বিএডিসি অফিস, গাইবান্ধা (ক্ষুদ্র সেচ) রিজিয়ন, গাইবান্ধা বরাবর আপিল আবেদন করেন। আপিল কর্মকর্তার নিকট থেকেও তথ্য না পেয়ে অভিযোগকারী তার চাহিত তথ্য পাওয়ার জন্য ২৫ জুন ২০২৩ তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন। ৩০ আগস্ট ২০২৩ তারিখের কমিশন সভায় অভিযোগটি পর্যালোচনান্তে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে ৪ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে (জুম অ্যাপ ব্যবহার করে) শুনানি গ্রহণের জন্য অভিযোগকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি তথ্য কমিশন থেকে সমন জারি করা হয়। শুনানির ধার্য তারিখে অভিযোগকারী সংযুক্ত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (জুম অ্যাপ ব্যবহার করে) সংযুক্ত না হওয়ায় পরবর্তী ১৯ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তথ্য কমিশনে শুনানি গ্রহণের জন্য অভিযোগকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি সমন জারি করা হয়। একইসাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গরহাজির থাকায় পরবর্তী শুনানিতে উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য জেলা প্রশাসক, গাইবান্ধাকে তথ্য কমিশন থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়। শুনানির ধার্য তারিখে অভিযোগকারী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাজির হন। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ নির্ধারণ করে তথ্য কমিশন ভবনে শুনানির জন্য অভিযোগকারী ও বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পূর্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আপিল কর্তৃপক্ষসহ ৪ জনকে তথ্য কমিশন থেকে সমন জারি করা হয়। পরবর্তী সময় অনিবার্য কারণবশত সরেজমিন শুনানির পরিবর্তে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে (জুম অ্যাপ ব্যবহার করে) শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৮ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে অভিযোগকারী ও প্রতিপক্ষ বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) এবং নির্বাহী প্রকৌশলী ভার্চুয়াল শুনানিতে সংযুক্ত হন।

অভিযোগকারী জানান, তিনি তার চাহিত তথ্য পাননি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য দেননি। তথ্য না পেয়ে তিনি তথ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), সহকারী প্রকৌশলী জানান, তিনি ১ জুলাই ২০২৩ তারিখে বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করেন। যে সময়ে ওই ব্যক্তি আবেদন করেছেন সেই সময় তিনি কর্মরত ছিলেন না। তবে কমিশনের সমন পাওয়ার পর আবেদনের বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তী সময় তথ্য সরবরাহের জন্য ১ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে আবেদনকারীকে তথ্যমূল্য পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছেন। অপরদিকে, পূর্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) সহকারী প্রকৌশলী জানান, তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তথ্য দিতে পারেননি। তবে তিনি তথ্য দেওয়ার জন্য বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (আরটিআই) চিঠি দিয়েছেন। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৭-এর (ছ), (জ), (ঝ), (ঠ) ধারা অনুযায়ী ‘ক’ ক্রমিকের চাহিত তথ্য প্রদানযোগ্য নয়। তিনি আরও জানান, তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নন, নির্বাহী প্রকৌশলী হলো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, অভিযোগকারীর যাচিত তথ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট থাকে না। উক্ত তথ্য থাকে উপজেলা সেচ কমিটির নিকট। পরবর্তী সময় অভিযোগকারীর যাচিত তথ্য উপজেলা অফিসের সেচ কমিটির নিকট থেকে সংগ্রহ করে অভিযোগকারীর নিকট সরবরাহ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) সহকারী প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

তথ্য কমিশন সব পক্ষের বক্তব্য শুনেন। যাচিত তথ্য সরবরাহযোগ্য হলেও প্রতিপক্ষ পূর্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য সরবরাহ করেননি এবং তথ্য প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। পরিপেক্ষিতে তথ্য কমিশন নিম্নের সিদ্ধান্ত দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করেন:

ক. তথ্যের মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে সিদ্ধান্তপত্র প্রাপ্তির পরবর্তী ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগকারীকে তার যাচিত সুনির্দিষ্ট তথ্যসমূহ তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে প্রত্যয়নপূর্বক সরবরাহের সহকারী প্রকৌশলী (বিএডিসি) ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), উপজেলা সেচ কমিটি; সুন্দরগঞ্জ, জেলা বিএডিসি (সেচ) অফিস, গাইবান্ধাকে নির্দেশ দেন। (খ) তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ২৭ (১) (ঙ) ধারা মোতাবেক ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য সরবরাহ না করে তথ্য প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় পূর্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) সহকারী প্রকৌশলী, বোয়ালমারী ক্ষুদ্র সেচ জোন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বোয়ালমারী, ফরিদপুরকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন। সেই সাথে ভবিষ্যতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য সহকারী প্রকৌশলী ও বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), বিএডিসি, সেচ ভবন, গাইবান্ধাকে সতর্ক করেন এবং নির্বাহী প্রকৌশলীকে অব্যাহতি দেন। সিদ্ধান্তপত্রের অনুলিপি সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং চেয়ারম্যান, বিএডিসি বরাবর প্রদানের নির্দেশ দেন।

তথ্য অধিকার আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ধারা ৩-এ আইনের প্রাধান্যের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তারপরেও মনোজগতে চাকুরি বিধি ইত্যাদির কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ তথ্য সরবরাহের বিষয়ে সংশয় ও দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর ধারা ১০-এ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কীভাবে তথ্য সরবরাহ করবেন সে বিষয়ে ধারা-০৯-এ উল্লেখ থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে তথ্য সরবরাহ করতে হবে কিনা বা তথ্য সরবরাহে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ অসন্তুষ্ট হবে কিনা এই বিষয়গুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের মাঝে দ্বিধা সৃষ্টি করে।

তথ্য অধিকার আইন একটি জনবান্ধব আইন। এই আইন পাশের মাধ্যমে জনগণের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর আইন। আইনটির প্রয়োগ বিষয়ে সর্বস্তরের জনগণের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। এ আইনটি যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটবে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা এই আইনের মূল লক্ষ্য। সরকারি সকল কার্যক্রমে গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয় হলো এই আইনের মূল চ্যালেঞ্জ। জনগণের দোরগোড়ায় তথ্য প্রদানের লক্ষ্যে সব সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করার জন্য তথ্য কমিশন বাংলাদেশ জোরালোভাবে ভূমিকা পালন করছে। এর ফলস্বরূপ দেশের তৃণমূল থেকে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন তথ্য পেতে খুব একটা ভোগান্তির শিকার হন না। যার ফলে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০