Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:30 pm

দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে

আমিনুল ইসলাম সুজন: রাজনীতি-সমাজ ও রাষ্ট্রের সবকিছুর অনুঘটক। একটি রাষ্ট্রের জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন-নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয় রাজনীতিকরা, যারা জনগণের ভোটে সরকার গঠন করে এসব দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক। রাজনীতি কলুষিত হলে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবকিছুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাগিদে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বাংলাদেশে বৈষম্য দূর করা যায়নি। মূলত রাজনীতি ইতিবাচক ধারায় পরিচালিত হয়নি বলেই এ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বরং রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কাছে হার মেনেছে। ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে বাকশাল কায়েম করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে যে কাউকে যে কোনো সময় আটকের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি নানা সংকটকাল অতিক্রম করেছে। গত ৫৩ বছরে রাজনীতিবিদদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অমানবিক নিপীড়ণ ও হয়রানির চিত্র সাধারণ মানুষদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রাজনীতির এ দুর্বৃত্তায়নের কারণে লুটেরা ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে রাজনীতি এবং প্রকৃত রাজনীতিবিদগণ সংখ্যালঘু হয়ে উঠেছিলেন। যে কোনো পেশাজীবী রাজনীতি করতে পারে। কিন্তু রাজনীতিতে যুক্ত না থাকা ব্যবসায়ী অর্থ বা পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হলে মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী রাজনীতিকরা কোণঠাসা ও হতাশ হয়ে পড়েন। বেশি পরিমাণে ব্যবসায়ী রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলে তারা মুনাফা অর্জনের বিষয়গুলো প্রাধান্য দেন। এতে ভোক্তা ও সেবাগ্রহণকারী জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশি দামে পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে বাধ্য হয়।

সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতির অভাবে দলীয় পরিচয় ও ঘুষের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির কারণে স্বেচ্ছাচারিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ফলে থানা, হাসপাতাল, ভূমি অফিসসহ প্রায় সর্বত্র সেবা গ্রহীতারা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতো, ঘুষ দিতে বাধ্য হতো। রাজনীতিকরণের বিচার বিভাগও সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক হয়রানির ক্ষেত্র হয়ে উঠে। উচ্চ আদালতের নিয়োগে যোগ্যতার চাইতে দলীয় পরিচয় মুখ্য হওয়ায় তা নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায়ও বিরূপ প্রভাব ফেলে। সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, লাখ লাখ মানুষ শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে আদালতে হয়রানির শিকার হতেন, জামিনযোগ্য মামলায় জামিন পেতেন না, বরং গণহারে রিমান্ডের ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়ে উঠে। বিচার প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপের উৎকৃষ্ট উদাহরণ সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। সম্প্রতি তিনি শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সবচাইতে জঘন্য স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে সুযোগ দেয়ার নিন্দা জানান এবং তার বিচার চেয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে একজন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতিকে কিভাবে ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন আদালতে, সংসদে ও গণমাধ্যমে হেনস্তা করা হয়েছে, বিচার বিভাগ কিভাবে কলুষিত করা হয়েছে তার বিবরণ দিয়েছেন বিচারপতি সিনহা, যা শুনলে যে কারও গা শিওরে উঠবে। এছাড়া আজ্ঞাবহ সাংবিধানিক (আদালত, দুদক), স্বায়ত্তশাসিত (বাংলাদেশ ব্যাংক) ও সরকারি (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, শ্রম অধিদপ্তর) প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে কিভাবে আগ্রাসী হেনস্তা করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সারা পৃথিবীতে শ্রদ্ধেয় নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস, যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দেশে ও বিদেশে বহুল আলোচিত ডিজিএফআই পরিচালিত ‘আয়নাঘর’। শত শত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুম করে বছরের পর বছর এখানে আটকে নির্যাতন করা হতো। অনেককে খুনও করা হয়েছে। এম ইলিয়াস আলীসহ বিএনপির অসংখ্য নেতাকে গুম-খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমালোচক ও তাদের স্বজনদের ধরেও আটকে নির্যাতন করা হতো। যেমন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানকে প্রথমে গুম ও নির্যাতন এবং পরে আটক ও হয়রানি করা হয়েছিল। অপর দুজন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ফরিদা আখতার এর স্বামীদের অপহরণ করা হলেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ায় তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যেহেতু ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পরিচালিত হতো তাই এসব গুম-খুনের দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর বর্তায়।
রাষ্ট্রের কোনো সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানই দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি থেকে মুক্তি পায়নি। যেমন: সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নাম সর্বাগ্রে আসে। দুদক সরকারের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে যত পদক্ষেপ নিত তার অধিকাংশই জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো না। দুদক কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত অনেকেই মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকত, তাদের বিরুদ্ধে দুদক নিশ্চুপ থাকত।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যসহ অন্যান্য প্রায় সব নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হতো। যে কারণে সরকারি ছাত্র সংগঠন নানা অপকর্ম করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নৈতিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত না।

মূলত আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কারণেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ৯১ সালে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলেও রাজনীতিকদের ব্যর্থতায় তা স্থায়ী করা যায়নি। শেখ হাসিনা জাতিয় পার্টি ও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তুমুল আন্দোলন করলেও ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেন। ফলে গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নির্বাসনে যায়। বিশেষ করে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি। বরং নির্বাচনের নামে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। ২০১৪ সালে ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড গড়ে। বাকি ১৪৭টি আসনের অধিকাংশ পূর্বনির্ধারিত ছিল, অনেকটা সিলেকশনের মতো। ২০১৮ সালে বহুল আলোচিত ‘রাতের ভোট’ হয়েছিল। ২০২৪ সালেও নির্বাচনের নামে নাটক হয়, অনেকটা সিলেকশনের মতো নির্বাচন হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নিজেরা নিজেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়।

দেশে গণতন্ত্র রহিত হওয়ায় মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসেনি। নিশ্চিত করা যায়নি মানুষের বাকস্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, সাম্য এবং নায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র। সর্বত্র স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে সরকার মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনও সরকার কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এতে সর্বাত্মক সমর্থন জানায়।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিএনপি-জামায়াত নয়, ডান-বাম অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে, সরকারের পুলিশ বা সরকারের ছাত্রলীগ ও যুবলীগ আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-সহ বাম ঘরানার দল কিংবা জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, প্রকৌশলী শহিদুল্লাহ, জোনায়েদ সাকির মতো ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি নিরীহ সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, সাধারণ শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী কেউই। বিশেষ করে, ২০১৮ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ হেলমেট পরে যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে তা সহজে ভুলবার নয়। ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার যারা হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্তদের একটা বড় অংশ (বা তাদের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধবরা) ২০১৮ সালে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কাছে মার খেয়েছেন।

রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন জেঁকে বসেছে তা শক্ত হাতে দূর করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার করা প্রয়োজন। রাজনীতি করা মানুষের অধিকার, তবে সাংবিধানিক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের সম্পূর্ণভাবে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করার বিধান রাখা হলে তার মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট ডিভিশনসহ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনীসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশ, ভূমি অফিস, হাসপাতাল, জনপ্রশাসনসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবান্ধব করতে হবে। ঘুষ ও দুর্নীতির সাজা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যে কোনো মূল্যে স্বচ্ছ করতে হবে। সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানবিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি সমূলে নির্মূল করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এটাই সবার প্রত্যাশা।