মো. মাঈন উদ্দীন: বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার সংকটের মুখে। বেশ কয়েক কাল ধরে অর্থনীতির অনেকগুলো খাত নি¤œমুখী অবস্থানে থাকা অবস্থায় সম্প্রতি কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। জিডিপি, বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, মূল্যস্ফীতি, লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট), আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রভৃতি খাতের নি¤œমুখী অবস্থান নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা যখন উদ্বীগ্ন, তখন আবার কোটার মতো সাধারণ একটি অরাজনৈতিক বিষয়ের সময়মতো সমাধান না করায় নাজুক পরিণতি বিরাজ করছে অর্থনীতিতে। শুধু তা-ই নয়, অনেকগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল। ক্ষতি হয়ে গেল দেশের সম্পদ ও অর্থনীতির। চলমান অস্থিরতায় আটকে আছে রপ্তানি, স্থবিরতা নেমে এসেছে শিল্প খাতে, উৎপাদন থেমে গেছে, দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ও নির্ভরতার ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সরবরাহ বিপর্যয় দেখা দেয়।
অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ ছিল। চলমান অস্থিরতায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করবে। বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে সংকট, নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি, রাজস্ব ঘাটতিতে ঋণনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ও ঋণের সুদ পরিশোধের দায় নিয়ে অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে। ১০০ বিলিয়ন ডলার যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে, সামনে তার কিস্তি শুরু হবে। এতে টাকার মান আরও কমতে পারে। বৈষম্য প্রকট হতে পারে। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পর্যায়ে তা চলে আসতে পারে। এমনি অনিশ্চিত ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে দেশ চলছে। ২০২১ সালে আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা।
২০২৪ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগ নীতি অনুসারে তা দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। এতে দুই বছরে টাকার মান অবমূল্যায়ন হয় ৩৮ শতাংশ। তাছাড়া প্রতি বছর টাকা পাচার হচ্ছে নানাভাবেÑহুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার, রপ্তানি আয় দেশে না আসা, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং প্রভৃতি। এছাড়া আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের আধিক্য বেড়ে গেছে। এসব ক্ষত অর্থনীতিকে দুর্যোগে ফেলেছে। কভিডকালে ২০১৯-২০ নাগাদ এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তখন জিএনআই ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। ২০২৩ সালের ৩০ জুন ছিল দুই হাজার ৭৬৫ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে জিএনআই দুই হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছে। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি স্বস্তিকর অবস্থায় না থেকে বরং জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর ২০২৩-২৪ শেষ করেছে সরকার।
বিদেশি ঋণের কিস্তির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে অনেক দিন ধরে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে আট শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনি¤œ। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি কনট্রাক্টরদের অর্থ এখনও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোও আমাদের কাছ থেকে অর্থ পাবে। বিদেশ থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ আমদানি করছি, সেক্ষেত্রেও কিছু অংশ বকেয়া রয়েছে। এগুলো তো বাংলাদেশকে শোধ করতে হবে। আর শোধ করতে গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়বে, তা কি আমরা সামলাতে পারব?
চলমান সংকট সম্পর্কে বলতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন অস্বাভাবিক সময়ের মধ্যে আছি। এটি মহামারি বা বৈশ্বিক মন্দার মতো পরিস্থিতি নয়, এর শান্তিপূর্ণ সমাধান আসতে হবে রাজনৈতিক পর্যায় থেকেই। সামনের দিনে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, তা ভাবতে হবে।’
স্বাভাবিকতায় ফিরতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা এসেছে। সেজন্য প্রথমেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারফিউ ওঠাতে হবে এবং উৎপাদন ও বাণিজ্য কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থায়।’ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, ‘অর্থনীতি আগে থেকেই সংকটে ছিল, এখন পরিস্থিতি আরও নাজুক। রাজনীতিকে বাদ দিয়ে অর্থনীতিকে চিন্তা করা যাবে না। টেকসই শান্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার।’ অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হলে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব পক্ষকে সহমর্মিতার পরিচয় দিতে হবে। প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে ভয়াবহ খাদের কিনারা থেকে রক্ষা করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আস্থার সংকট দূর করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলের অনিয়ম ও দূর্নীতি দূর করে আস্থার জায়গা করতে হবে। খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে হবে। দুর্বল ব্যাংকের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। মেট্রোরেল ও জনকল্যাণমূলক সেবার স্থাপনা দ্রুত মেরামত করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁট করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিতে হবে। নৈতিকতা ও দেশের সম্পদ সুরক্ষার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় সংযোজন করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে হবে।
কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের যে ব্যাপক বেকার, শিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত জনবল রয়েছে, তা বিদেশে পাঠাতে হবে। তারাই আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও রেখে যাবে। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটা পুরোপুরি দূর করতে হবে। যারা সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিক। নির্দোষ কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়। সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে আসুকÑএটাই সবার প্রত্যাশা।