দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

শামীম আযাদ: বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী আলাদা পরিচিতি রয়েছে। ‘বিশ্ব ঝুঁকি সূচক, ২০১৬’ অনুসারে পৃথিবীর ১৭১টি দেশের মধ্যে অবকাঠামো ও ফসলাদি, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিকুলের আপদ উš§ুক্ততা, দুর্দশা, বিপদগ্রস্ততা, সহনশীলতা ও অভিযোজন সূচকের সামগ্রিক ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। সব দুর্যোগেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, বৃদ্ধ, শিশু ও প্রতিবন্ধীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দুর্যোগকালে দুস্থ লোকজনকে তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, সেবা, আশ্রয় বস্ত্র প্রভৃতি জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া দরিদ্র ও নিঃস্ব জনগোষ্ঠীকে বছরব্যাপী অর্থ ও খাদ্য সরবরাহ করাসহ পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্থায়ীভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাও এ মন্ত্রণালয়ের কাজ। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি ও জনগোষ্ঠীর সচেতনতার কারণে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। নগর অবকাঠামো, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ঝুঁকি হ্রাসকল্পে সরকার বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পেয়ে দেশ ও জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি দর্শন হচ্ছে প্রাকৃতিক, পরিবেশগত ও মানবসৃষ্ট আপদ থেকে জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারণের বিপদাপন্নতা হ্রাস এবং বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম এমন জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সরকার দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দুর্যোগ মোকাবিলায় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, যেমনÑবন্য আশ্রয়কেন্দ্র, উপকূলীয় এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, ঘূর্ণিঝড়সহনীয় ঘরবাড়ি, ছোট ও মাঝারি আকারের সেতু/কালভার্ট নির্মাণ এবং ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগে উদ্ধারকারী যন্ত্রপাতি ক্রয় ও উদ্ধারকাজে সার্বিক সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্য ১, ১১ ও ১৩, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) এবং ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে ১৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২টি প্রকল্প এবং বিভিন্ন ত্রাণ ও সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম সরকার পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রমে নারীরা বেশি উপকৃত হবে, কারণ দুর্যোগের সময় নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ এবং এরই ধারাবাহিকতায় ‘দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ‘প্র্যাকটিস জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন ইন ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ শীর্ষক একটি ফ্যাসিলিটেটর গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিত করার মাধ্যমে দুর্যোগকালীন ঝুঁকি পর্যালোচনা করে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করা। গাইডলাইনটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবীর সচেতনতা বৃদ্ধিতে, সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এলাকার মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি হ্রসে সহায়তা করছে। গাইডলাইনটি দুর্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা এবং জরুরি সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের সম্পৃক্তকরণে দিকনির্দেশনা প্রদান করছে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করায় এবং এসব কার্যক্রমে নারীদের সম্পৃক্ত করে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার ফলে দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। দুর্যোগের সর্তকবার্তার পর নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয় এবং দুর্যোগকালে ওষুধ ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়। এর মাধ্যমে নারীর দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পায়, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দুর্যোগ সম্ভবনাকালে বিশেষত নারী ও শিশুদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের পূর্বাভাস দেয়া হয়। এর ফলে দারিদ্র্য ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস পাচ্ছে।

বন্যায় আক্রান্তদের বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের উদ্ধার এবং তাদের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য এরই মধ্যে ৩০টি মাল্টিপারপাস অ্যাকসেসিবল রেসকিউ বোট সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে আরও ৩০টি এ ধরনের বোট সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া প্রকিউরমেন্ট অব ইক্যুইপমেন্ট ফর সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন অন আর্থকোয়েক অ্যান্ড আদার ডিজাস্টার (পেজ-২) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্ধার ও অনুসন্ধানী যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে দুই হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন উদ্ধারকারী যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে। দুর্যোগকালীন সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন সংস্থা, যেমনÑতিতাস গ্যাস, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্সসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার ৩৫০ কর্মকর্তাকে উন্নত জিআইএস সিস্টেমের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ নারী প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে। হারমোনাইজড ট্রেনিং মডিউলের আওতায় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৪ হাজার ৯৩ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে। এরই মধ্যে ৩৫ হাজার নগর দুর্যোগ স্বেচ্ছাসেবক এবং সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রামের (সিটিপি) আওতায় ৭৬ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮ হাজারেরও বেশি নারী।

সীমিত সামর্থ্য নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এক রোল মডেল। দুর্যোগপ্রবণ এদেশের মানুষ প্রতিনিয়ত নানারকম প্রাকৃতিক ও মানুষসৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবিলা করে বেঁচে আছে। দুর্যোগ-পূর্ব ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথাসম্ভব সীমিত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের ব্যক্তিরা করে থাকেন। আর এর মাধ্যমেই আমাদের সামাজিক ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পিআইডি ফিচার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০