শিল্পসমৃদ্ধ নরসিংদীতে কাপড়ের ব্যবসা যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনি কৃষি খাতেও সুনাম রয়েছে এ জেলার। আশার কথা, এবার এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঁশ ও বেতশিল্প।
বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে দেশের বাজারগুলোর চাহিদা মেটাচ্ছেন এখানকার কারিগররা। জেলার শিবপুর উপজেলার খৈনকুট গ্রামের দু’শতাধিক পরিবার নিয়মিত বাঁশ ও বেতের পণ্য তৈরি করে আসছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত মূলধন না থাকলেও পেশাটাকে তারা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে শিবপুর উপজেলার খৈনকুন গ্রামের দু’শতাধিক পরিবার।
খৈনকুট গ্রামটির অবস্থান শিবপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাটির যোগাযোগব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বেশ নাজুক। সম্প্রতি যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে। সংগত কারণে এখানকার পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় বেশ এগিয়েছে। এলাকাটি লাল মাটি ও টিলাটেঙ্গর বেষ্টিত হওয়ায় এখানে হরেক রকমের ফলের চাষ করা হয়। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে এ এলাকার সাধারণ জনগণ। এখানে দীর্ঘদিন ধরে বাঁশ-বেতের কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছেন দু’শতাধিক পরিবারের সদস্য।
গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ মোতালিব মিয়ার কাছে তার এ পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি আগে অন্যত্র তাঁতের কাজ করতাম। পরে ২০ বছর ধরে এই বাঁশ-বেতের কাজ করেই সংসার চালাচ্ছি। আমার এ সময় বিশ্রাম নেওয়ার কথা থাকলেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি অবিরাম। এতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। আমি এক পর্যায়ের কাজ করে দিলে বাকি কাজ আমার ছেলে করে। এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে দেখে দেখে শিখে নিয়েছি। একই এলাকার মোস্তফা মিয়া জানান, আমরা এ এলাকায় বেলা, পুরা, ঝুড়ি, টুকরিসহ প্রায় পাঁচ ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে থাকি। পরিবারের বড়দের কাছ থেকে এ কাজ দেখে শিখেছি। আমাদের কোনো কারিগরি শিক্ষা নিতে হয়নি। তাই আমাদের যদি কোনো সংস্থা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করত, তাহলে আরও হরেক পণ্য তৈরি করতে পারতাম। এছাড়া আমাদের তেমন কোনো পুঁজি নেই। অল্প পুঁজি দিয়ে বাঁশ কিনি, পরে পণ্য তৈরি করি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় পাইকাররা সপ্তাহে একদিন এসে আমাদের পণ্যগুলো নিয়ে যান।
ভৈরবের হাজী আসমত ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. সোহেল মিয়া জানান, আমি শিবপুরের খৈনকুট এলাকায় মামার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করি। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি এই বাঁশ-বেতের কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে যাচ্ছি। এতে করে মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয় আমার। এখন লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালাতে পারি। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে সুবিধা হতো।
এ এলাকার সূর্যবানের বয়স প্রায় ৭০ বছর। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। একটি ছেলে রিকশাচালক। তিনি বলেন, আমি সংসারের অভাব-অনটন বুঝি, তাই বাঁশ ও বেতের কাজ করে আমার ছোটোখাটো খরচ আর পানের পয়সা নিজেই জোগাড় করি। তাই এলাকার অন্যদের মতো খুচি তৈরির কাজ করি। একটি খুচি তৈরি করলে তিন টাকা পাই। এভাবে মাসে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা রোজগার করতে পারি। এ কাজে তেমন কষ্ট নেই।
পাইকার আলমাছ মিয়া বলেন, ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যের একটি উন্নয়ন সংস্থা কিছু লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। সেই থেকে এলাকায় এ কাজের যাত্রা শুরু। তবে বর্তমানে সরকার কিংবা কোনো বেসরকারি সংস্থা বেকারদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা করলে এলাকাটি কুটিরপল্লি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
শিবপুর উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শিকদার মাহমুদ হোসেন বলেন, এ এলাকার মানুষের জন্য আমরা যুব উন্নয়নের মাধ্যমে কুটিরশিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। প্রশিক্ষণ শেষে পরিবারভিত্তিক ঋণ দিয়ে এলাকার বেকারত্ব দূর করে এই বাঁশ-বেতের শিল্পটিকে আরও বেগবান করার জন্য চেষ্টা করব। বিসিক ও কুটিরশিল্প বিষয়ক জেলা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, আমাদের জনবল ও আর্থিক কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ নিতে পারি না। তবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেলে এলাকাটি হয়ে উঠতে পারে একটি কুটিরপল্লি।
এম. লুৎফর রহমান