বাংলাদেশের ব্যাটারিশিল্পের পথিকৃৎদের একজন মো. লোকমান হোসেন। শ্রমিক হিসেবে ব্যাটারিশিল্পে প্রবেশ; এরপর ১৯৮০ সালে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় কয়লার ব্যবসা দিয়ে শুরু। পরে সিসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত ব্যাটারি কারখানা গড়ে তোলেন। বর্তমানে তিনি দেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পান্না গ্রুপের কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যাটারির পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ও পাট খাতেও পান্না গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ
পান্না গ্রুপের শুরুর গল্পটা জানতে চাই…
মো. লোকমান হোসেন: আমি মাত্র আট বছর বয়সে ১৯৭২ সালে ফরিদপুর থেকে মামার সঙ্গে ট্রাকে চড়ে প্রথম ঢাকায় আসি। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। স্বাধীনতার পরে মিথ্যা হত্যা মামলায় লড়তে গিয়ে আমার বাবা সর্বস্বান্ত হন। এ কারণে ওই বয়সেই জীবন-জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসতে হয়। পুরান ঢাকায় আল মদিনা নামের একটি ব্যাটারি কারখানায় কাজ নিই। তারা সপ্তাহে ১০ টাকা ও খাবার দিত। কাজ শেখার পর মাসে ১৫০ টাকা বেতন পেয়েছি। কষ্ট হলেও আমি কাজ শেখার চেষ্টা করেছি; কয়েক বছর সেখানে কাজ করেছি।
নিজের ব্যবসা শুরু এবং পুঁজি জোগাড় করলেন কীভাবে?
লোকমান হোসেন: আমি ওই চাকরিটা ১৯৮০ সালে ছেড়ে দিই। সংসার আর নিজের ব্যয় মেটানোর পর তখন আমার কাছে সাড়ে তিন হাজার টাকা ছিল। সেটাকে পুঁজি হিসেবে নিয়েই ব্যবসা শুরু করি। এ টাকা দিয়ে তখন কোনো ব্যবসা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া তেমন কোনো ব্যবসা আমি জানতামও না। ব্যাটারি কারখানায় সিসা গলানোর জন্য কয়লা ব্যবহার করা হতো। আমি ওই পুঁজি দিয়ে এবং কিছু টাকা দিয়ে বাকিতে কয়লা কিনে ব্যাটারি কারখানায় সরবরাহ করি। পুঁজি কম থাকায় বাকিতে কয়লা নিই। বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করি। এভাবে এক বছরে হাতে কিছু টাকা জমে। ১৯৮১ সালে ব্যাটারির মূল কাঁচামাল সিসা গলিয়ে তা বিভিন্ন ব্যাটারি কারখানায় বিক্রি শুরু করি। এরপর ব্যাটারি কারখানা করার চিন্তা মাথায় আসে।
এরপর…
লোকমান হোসেন: ১৯৮২ সালে ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করি। প্রথম মাসে আড়াইশ ব্যাটারি তৈরি করে বাজারজাত করি। এভাবেই পথচলা শুরু। শুরু থেকে ব্যাটারির গুণগত মান ঠিক রাখার দিকে নজর দিই। এতে গ্রাহক তৈরি হলো বেশ। তারপরও জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। ব্যবসায় বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখেও পড়েছি। তবে হতাশ হইনি কখনো। ধৈর্য ধরে কাজ করেছি। আমার প্রথম জীবনের সহকর্মীদের অনেকে কোনো না কোনো কারখানায় কাজ করছেন। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার গ্রুপে এখন কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের বাজারে জনপ্রিয় ব্যাটারির নাম বললেই এখন পান্না গ্রুপের নাম চলে আসে।
আপনার ব্যবসায় এগিয়ে থাকার মূলমন্ত্র কী?
লোকমান হোসেন: একজন মানুষ শ্রম ও সততা দিয়ে চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হবেন। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের সততা আর শ্রম কখনও বিফলে যায় না। আর বড় হওয়ার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। আমি যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, ধৈর্য ধরে এখনও সেটিতেই আছি। অনেক ঝড় এসেছে, পুঁজি হারিয়ে হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপরও কাজ করে গেছি। কখনও থেমে থাকিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দু-চার টাকা বেশি লাভের আশায় কাউকে ঠকানো যাবে না। ফলশ্রুতিতে গ্রাহক আর কর্মীবাহিনীসহ সবার সহায়তায় সামান্য একজন কর্মী থেকে আজ শিল্পোদ্যোক্তা হয়েছি।
শ্রমিক স্বার্থের কথা বলছিলেন, বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
লোকমান হোসেন: আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৫ হাজার কর্মী আছেন। আমি তাদেরকে আমার পরিবারের সদস্য, আমার সন্তান বলেই মনে করি। আজ আমি বেশ ভালো জীবনযাপন করছি। এর মূল কারিগর আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সুতরাং তাদের ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। একসময় আমি নিজেও শ্রমিক ছিলাম, তাদের কষ্টটা অনুভব করি। আর ব্যাটারি কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের দিকে সব সময় নজর দিতে হয়। শ্রমিকদের কোম্পানির পক্ষ থেকে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করি। কারখানায় সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের একটি অংশ ‘প্রফিট বোনাস’ হিসেবে এখানে কর্মরতরা পান। ব্যবসায় লোকসান হলেও শ্রমিকদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠান চালু রাখছি বা চালাচ্ছি।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ…
লোকমান হোসেন: কোনো ব্যবসা করতে হলে আগে সে সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। সেটি ওই খাতে চাকরি করেও হতে পারে। অন্য যে কোনো উপায়েও হতে পারে। একটি ব্যবসা সম্পর্কে না জেনে সেখানে বিনিয়োগ করলে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই না জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করে কোনো ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না। এরপর বলব, হঠাৎ করে বড় কিছু না করে ছোট আকারে শুরু করা ভালো। এতে ঝুঁকির শঙ্কা কম থাকবে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যবসার পরিধি বাড়লে সেটা সব দিক দিয়ে ভালো।