রাজধানী ছেড়ে নেত্রকোনার এক হাওরে যাচ্ছি। খালিয়াজুরী হাওরে। হাতে সময় মাত্র তিন দিন। ট্রেনে চড়ে যাব। অফিস থেকে অগ্রিম ছুটি নিয়ে হাওরে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে এক সন্ধ্যায় টিএসসিতে আমরা সবাই এক হলাম। আমাদের ১১ জনের গন্তব্য ওই হাওরে। দলে ছিলেন রনি ভাই, আদনান ভাই, মেহেদি ভাই, টুটুল, মাহবুব, বাশার, শাকিল, জুয়েল, সাগর ও মিঠু। আমরা সবাই গণমাধ্যমকর্মী।
ট্রেনে দুই কেবিনের ছয়টি সিট নিয়েছি। তবে এক কেবিন ছেড়ে অন্য কেবিনে যেতে নারাজ সবাই। তাই অন্য কেবিনের দুই সিট খালি রেখেই এক কেবিনে আমরা ১১ জন। জানালার পাশের সিট শুরুতেই আমার দখলে। ট্রেন ছেড়েছে। রাত গভীর হচ্ছে। ততক্ষণে কেবিনের ওপর ও নিচের সিট যে যার মতো দখলে নিয়ে নিয়েছে। মাহবুবের হাতে কাহন, সাগরের হাতে ইউকেলেল। পুরো ট্রেন তখন প্রায় ঘুমে। আমাদের কেবিনে আনন্দ চলছে। মাহবুব, সাগর, রনি ভাই সবার কণ্ঠে একের পর এক গান চলছে। কেবিন পেরিয়ে যারাই হেঁটে যাচ্ছেন, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। মাঝে এক চা বিক্রেতা এসে আমাদের আসরে যোগ দেন।
সকাল ৬টায় আমরা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ স্টেশনে নামলাম। এ রুটের শেষ স্টেশন এটি। সারা রাত দু-একজন ছাড়া কারও চোখ একবারের জন্যও বন্ধ হয়নি। নির্ঘুম রাত শেষে সবাই তাই ক্লান্ত। স্টেশনের দোকানগুলো তখনও খোলেনি। একটু সামনে এগোতেই একটি রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাই। সেখানে সকালের নাশতা শেষ করে অপেক্ষা করছি ফেরার অগ্রিম টিকিট সংগ্রহের জন্য। সকাল ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর টিকিট পেলাম। স্টেশন থেকে কিছুদূর হেঁটে একটি লেগুনা ভাড়া করলাম। জনপ্রতি ভাড়া ৫৫ টাকা। আমাদের গন্তব্য বোলিয়া ঘাট। সেখান থেকে যাত্রীবাহী ট্রলারের ছাদে চড়ে খালিয়াজুরী রওনা হই।
আমাদের মধ্যে সাতজন ফটোগ্রাফার। পুরো ট্রলারের ছাদ দখল করে চলছে তাদের ফটোগ্রাফি। ট্রলার কিছুদূর যেতে যতদূর চোখ যায়Ñশুধু পানি আর পানি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর খালিয়াজুরী ঘাটে পৌঁছালাম। ঘাট থেকে বের হতেই ছোট বাজার। বাজার পার করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। কংক্রিটের রাস্তা, এক পাশে গ্রাম, অন্যপাশে যতদূর চোখ যায় হাওরের পানি। মনে হচ্ছিল কোনো চিত্রশিল্পী রং-তুলি দিয়ে এঁকেছেন গ্রামটি। প্রথম দেখাতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। এ গ্রামে থাকার মতো বেসরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সরকারি ডাকবাংলোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। রাস্তা ধরে ডাকবাংলো যেতে ১০ মিনিটের পথ। হাওরের বাতাস গায়ে লাগিয়ে গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা ডাকবাংলোয় ঢুকলাম। বাংলোর নিচে ছোট একটি বাজার। সেখানে একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে সবাই ঘুম দিই। সন্ধ্যার আগে সবার ঘুম ভাংলে গ্রাম ঘুরতে বের হই।
খালিয়াজুরী নেত্রকোনার একটি উপজেলা। বছরের প্রায় সাত মাস পানি থাকে এর বিভিন্ন স্থানে। বাকি মাসগুলো পানি শুকিয়ে গেলে বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়। আর পানি চলে এলে সেসব ফসলচাষির অনেকেই মাছ ধরা ও নৌকায় যাত্রী পারাপারের কাজ করেন। প্রতিদিন সকালে আশেপাশের গ্রাম থেকে নৌকা ভাড়া করে এক সঙ্গে কয়েকজন খালিয়াজুরী হাওরে আসেন। কারও উদ্দেশ্য হাটে পণ্য বিক্রি, আবার কারও উদ্দেশ্য কেনাকাটা। সকাল ১১টা থেকে দুপর ১২টার মধ্যে সবাই বাজার সদাই শেষ করে আবার সে নৌকায় চড়ে নিজ গ্রামে ফিরে যান। এখানে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজেও আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেকে আসেন। তাদের সবার বাহন নৌকা বা ট্রলার।
কিশোরগঞ্জ কিংবা সুনামগঞ্জের হাওর হিসেবে পরিচিত হলেও খালিয়াজুরী হাওরের কথা খুব মানুষই জানে। তাই পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এখনও তৈরি হয়নি এটি। আর এ কারণে থাকা বা খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। খালিয়াজুরী গ্রামটি গত বছর পর্যন্ত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রায় এক কিলোমিটার পথ পার হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল সাঁকো। সে সমস্যা এখন সমাধানের দিকে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানে একটি রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা নেন। সে রাস্তা নির্মাণের কাজ এখন চলছে। খালিয়াজুরীর অবস্থা অনেকটা দ্বীপের মতো। এখান থেকে মূল শহরে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। সুবিধাবঞ্চিত প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বলা যায় একে। এর চারদিকেই অথৈ পানি। উপজেলার মর্যাদা পাওয়া গ্রাম থেকে তুলনামূলক অনুন্নত।
গ্রামে বিদ্যুতের অবস্থাও সুবিধার নয়। আমরা যাওয়ার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল। প্রথম দিন গ্রাম দেখতে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর অন্ধকার নেমে আসে। বাংলোর নিচের বাজারে সবাই চা খেয়ে বাজারের ঠিক পেছনে ছোট একটি বালুর মাঠে চলে আসি। মাঠ নেমে গেছে হাওরের দিকে। এক-দুটি নৌকা তখনও সেখানে। অন্ধকার হাওরে নৌকায় পা ঝুলিয়ে বাতাসের শব্দ শুনছি। গ্রামে জলদি রাতের খাবার খেতে হয়। যেহেতু আমাদের বাংলোতে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই একটি রেস্টুরেন্ট ঠিক করে রাখি খাওয়ার জন্য। এখানে বেড়াতে এলে যে হোটেলে খাবেন, আগেভাগে তাদের বলে রাখতে হবে। রাতে নির্ধারিত হোটেলে খাওয়া শেষ করে বাংলোয় ফিরলাম। বিদ্যুৎ নেই।
রাত প্রায় ১টা। আমরা হাওরপাড়ে গিয়ে বসি। প্রচণ্ড বাতাস আর হাওরের পানি পাড়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে আছে। হাওরপাড়ে আমরা ১১ জন। হাওরের রূপ যেন সমুদ্র হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে পানিতে নামছি সবাই। মাঝরাতে প্রকৃতির এই আবেদনে শুধু চোখ দিয়ে দেখে মন জুড়াল না। তাই হাওরে প্রায় গলা পানিতে নেমে গেলাম সবাই। বাতাসের পরিমাণ বেশি থাকায় ঠিক যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পানি এসে গায়ের ওপর ঝাপটে পড়ছে। মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গে আছি। গলা পানিতে ডুবেই আড্ডা জমেছে আমাদের। প্রায় দুই ঘণ্টা পর বাংলোতে ফিরলাম।
সকাল হতেই কেউ ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়েছেন, কেউ-বা ঘুমাচ্ছেন। সকালে সবাই নাস্তা শেষ করে আবারও হাওরপাড়ে নৌকায় বসে আছি। বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ আসছে। তাদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলি। আড্ডা দিই। সময় গড়ায়। আমরা আবারও পানিতে নেমে যাই। ইচ্ছেমতো হাওরের পানিতে সাঁতার কাটি।
বিকালে ট্রলার ভাড়া করে হাওরে ঘুরতে বের হলাম। ছোট ছোট গ্রাম ঘেঁষে আমরা হাওর দেখছি। দূরে সারি বেঁধে কতগুলো গাছ প্রায় অর্ধেক হাওরের পানিতে ডুবে গেছে। পুরো বিকাল ঘুরে আবারও সন্ধ্যায় হাওরপাড়ে আড্ডা আর গান। হঠাৎ পাশে কীর্তন শুনতে পেলাম। প্রতি সপ্তাহে একটি নির্ধারিত দিন কীর্তন বসে এখানে। গ্রামের একটি অংশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাস করে। আমরা সবাই কীর্তন শুনতে গেলাম। কীর্তন শোনা শেষ হলে রাতের খাবার খেয়ে বাংলোয় ফিরলাম। মাঝরাতে আবারও গতরাতের মতো জলজলসা।
পরদিন বিকালে ট্রলার করে আবারও যাত্রা শুরু কংক্রিটের শহরের দিকে।
শরীফুল ইসলাম