দূষিত মেগাসিটির তালিকায় দিল্লি কায়রোর পরই ঢাকা

ইসমাইল আলী: ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। তা সত্ত্বেও জ্বালানি হিসেবে পুড়ছে কাঠ। কয়লার ব্যবহার হলেও অনেক সময় তা অতিরিক্ত সালফারযুক্ত। এর ওপর রয়েছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা। এসব থেকে নির্গত ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে বাতাস। এর সঙ্গে রাস্তার ধুলোবালি মিশে বাড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি। ফলে দূষণে ভারী হয়ে উঠছে ঢাকার বাতাস। এর মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে ছাড়িয়ে গেছে সব ধরনের গ্রহণযোগ্য মাত্রা।

বায়ুদূষণের ফলে মৃত্যুতে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। তবে পুরো দেশের মধ্যে এর মাত্রা সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। বিশ্বের বিভিন্ন মেগাসিটির মধ্যেও ঢাকার বায়ুর অবস্থা খুবই খারাপ। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত ‘অ্যামবিয়েন্ট এয়ার পলিউশন: অ্যা গ্লোবাল অ্যাসেসমেন্ট অব এক্সপোজার বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বায়ুর গুণাগুণ পরিমাপে প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয় ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম১০) পরিমাণ। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তার ধুলো-ময়লা, যানবাহন ও কারখানার নির্গত ধোঁয়া ও ক্ষতিকর পদার্থ। আর কমপক্ষে এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের বসবাসের শহরকে মেগাসিটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ হিসাবে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত মেগাসিটি ভারতের রাজধানী দিল্লি। শহরটির প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ২৩০ মাইক্রোগ্রাম। যদিও ডব্লিউএইচওর হিসাবে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ২০ মাইক্রোগ্রাম ক্ষুদ্র বস্তুকণা গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিসরের রাজধানী কায়রো। শহরটিতে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ১৭৫ মাইক্রোগ্রাম। আর ঢাকায় এ পরিমাণ ১৫০ মাইক্রোগ্রাম। তালিকায় এরপর রয়েছে ভারতের দুই শহর কলকাতা ও মুম্বাই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিল্লিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে গত বছর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে সপ্তাহের এক দিন জোড় সংখ্যা ও অপর দিন বেজোড় সংখ্যার গাড়ি চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপরও শহরের বায়ুর গুণাগুণের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।

এদিকে ঢাকার বায়ুর গুণাগুণ উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া হয় ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস) প্রকল্প। তবে এর কোনো প্রভাবও দেখা যায়নি ঢাকার বায়ুর মান উন্নয়নে। কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ আর ফুটপাত উন্নয়ন ছাড়া এ প্রকল্পের কোনো প্রাপ্তি নেই বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছর ঢাকার বায়ুর মান নিয়ে যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদফতর ও নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চ। কেস প্রকল্পের সুফল, ঢাকার বায়ুর বর্তমান অবস্থা ও ২০২০ সালে কোন পর্যায়ে থাকবে, তা যাচাইয়ে সমীক্ষাটি চালানো হয়। ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড যে সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। যদিও বর্ষা মৌসুমে বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা কিছুটা কমে আসে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের বায়ুতে প্রতিবছর ক্ষুদ্র বস্তুকণা মিশছে ৫৮ হাজার ৫২৪ টন। পাশাপাশি ২০ হাজার ৮১৯ টন অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) তথা লোহা, সিসা, জিংক ইত্যাদির বিষাক্ত জৈব মিশছে বাতাসে। এছাড়া প্রতিবছর ৬০ হাজার ২১৬ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১৪ হাজার ৮৬২ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ৫৩ হাজার ৪৫ টন কার্বন মিশছে ঢাকার বায়ুতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশে গড়ে ওঠা ট্যানারি, সিমেন্ট, প্লাস্টিক শিল্প ও ইটভাটা থেকে প্রচুর ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়। কোনো ধরনের পরিশোধন ব্যবস্থা না থাকায় সরাসরি তা ঢাকার বায়ুতে মিশছে। এছাড়া ঢাকায় মোটরযান বাড়ছে। এর প্রভাবেও বায়ুদূষণ হচ্ছে। আর কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইড ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হৃিদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হৃদযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে বাতাসে থাকা মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সিসা।

পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকার বাতাসের মান খারাপ হচ্ছে, তা নানা গবেষণায় এর আগেই উঠে এসেছে। এর মূল কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দূষণ রোধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এক্ষেত্রে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্তমানে ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে গড় ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৩৫৩ মাইক্রোগ্রাম। তবে বাণিজ্যিক ও শিল্পঘন এলাকাগুলোয় এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে গড়ে এক হাজার ২৩৮ মাইক্রোগ্রাম। এছাড়া ঢাকার বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড প্রতি ঘনমিটারে রয়েছে গড়ে যথাক্রমে ৬৮ ও ৪৮ মাইক্রোগ্রাম। শুধু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করলে বায়ুর এ দুই উপাদানের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে এক হাজার ৩১ ও ৮৭ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইডের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০ মাইক্রোগ্রাম।

এ বিষয়ে কেস প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বর্ষাকালে বাতাসের বায়ুর মান বেশ ভালোই থাকে। তবে শুষ্ক মৌসুম নিয়ে চিন্তা। এজন্য কেস প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইটভাটাগুলো আধুনিকায়ন প্রকল্প বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে। এছাড়া ঢাকার যানজট কমাতে বেশকিছু ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, ঢাকার বাতাসের মান ভবিষ্যতে উন্নত হবে।

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০