নোমান বিন হারুন: ২০২২ সালে শ্রীলংকায় মুল্যস্ফীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৯৫ শতাংশে পৌঁছানোর পর খাদ্যের মূল্যও রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যায়। জ্বালানি সংকটে দিনের পর দিন ফিলিং স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তেল পায়নি মানুষ। খাদ্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে দিশেহারা হয়ে পড়ে সবাই। শুরু হয় বিক্ষোভ। জুলাইয়ে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। রাজাপাকসের পদত্যাগের পর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় আসেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস হলো দেশটির পর্যটন খাত। কভিড মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন নির্ভর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়ে দেশটি। মহামারির কারণে রেমিট্যান্স খাতেও বিপর্যয় নেমে আসে। অন্যদিকে ক্ষমতায় এসে দেশে অর্গানিক কৃষি উৎপাদন শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। কৃষিক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার। সার আমদানিও নিষিদ্ধ করার এ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কৃষিক্ষেত্রে। চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে আসে। ফলে বাধ্য হয়ে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে চাল আমদানি করা হয়। অর্গানিক কৃষি উৎপাদনের সিদ্ধান্তে একই সময়ে চা উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। চা রপ্তানি খাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায়ও বড় ধাক্কা লাগে। সবমিলিয়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে উলটো আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়।
একই সময়ে শ্রীলংকা গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সড়ক-মহাসড়ক এবং আরও নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি, বিভিন্ন উৎস থেকে তারা ঋণ নেয়। বিপুল অর্থ খরচ করা এসব প্রকল্পের অধিকাংশই আশানুরূপ লাভজনক হয়নি। ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ‘সার্বভৌম বন্ডে’র সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। আয় থেকে ব্যয় বেশি হলে এ ধরনের সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে, সে ব্যাপারে আগে কার্যকর কোন পরিকল্পনা তাদের ছিল না। পরবর্তীতে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা বিপুল পরিমাণ ঋণের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হয়। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে সংকটে পড়তে হয় তাদের। দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য ভ্যাট ও কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসে। কর কমানোর পদক্ষেপ ছিল একটা বড় ভুল। ফলে সরকার আরও ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
আন্দোলন পরবর্তী সরকারের নানা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে বর্তমানে অনেকটাই শান্ত হয়ে উঠেছে দেশের পরিস্থিতি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ও বেকারত্বের কারণে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে সে দেশের মানুষ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলেও খাদ্য ও জ্বালানি তেলের সংকট কিন্তু রয়েই গেছে। জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থা আগের তুলনায় আরও ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি তো ঘটবেই না; বরং মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। চলতি বছরে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও গভীর সংকটে পড়বে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ আশংকা করলেও আপাতদৃষ্টিতে এ সংকট কাটিয়ে উঠছে বলে মনে করছেন তারা। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ব্যবসা ও বাজার অর্থনীতিবিষয়ক ওয়েবসাইট ব্লুমবার্গে অর্থনীতি বিষয়ক স্কলার অনকুর শুক্রা সতর্ক করে বলেছেন, কড়াকড়ি অর্থনৈতিক পলিসি ও দ্রুত মুদ্রাস্ফীতির জন্য শ্রীলংকা আরও একবার গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ অর্থনীতিবিদের নিজস্ব জরিপ অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গ্রস প্রডাক্ট ৮.৪ শতাংশ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার কথা রয়েছে।
এত খারাপ খবরের মধ্যে আশাব্যঞ্জক খবরও আছে শ্রীলংকার জন্য। তাদের বিদেশি মুদ্রার অন্যতম উৎস পর্যটনব্যবস্থা ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। শ্রীলংকার জিডিপির ১২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। এত বিপর্যয়ের মধ্যেও ২০২৩ সালে দেশটিতে প্রায় ৮ পর্যটক ভ্রমণ করেছে। অথচ ২০২১ সালে বিদেশি পর্যটক এসেছিলেন ১ লাখ ৯৪ হাজার পাঁচশর কাছাকাছি। অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে তারা ভারত, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ’র বিষয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এর ফলে অনেকটাই চাঙা হয়ে উঠবে দেশের অর্থনীতি। অপরদিকে বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন ও ভারতের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে আলোচনায় বসে শ্রীলংকা। দেশটির এফটিএ আলোচনার প্রধান সমন্বয়কারী কে জে ভিরাসংহে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য তাদের চেষ্টার শেষ নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক।
এদিকে আইএমএফের ঋণ পাওয়ায় শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। জুলাইয়ের শেষে দেশটির রিজার্ভ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৫৬০ কোটি ডলার, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৪৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ সাত মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১২০ কোটি ডলার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া। ২০২২ সালে প্রতি ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময় মূল্য ৩৬৩ তে ছিল; গতবছর তা ৩২০ রুপিতে নেমে আসে। এখন তা ২৯৭ রুপিতে নেমে এসেছে।
এসব কিছুর সম্মিলিত ফল হলো টানা তিন প্রান্তিকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। টানা পাঁচ প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার পর ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। তখন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রবৃদ্ধির হার আরও বেড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়। টানা দুই বছর অর্থনৈতিক সংকোচনের পর চলতি বছর সামগ্রিকভাবে দেশটি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন শুরু করে শ্রীলঙ্কা। বেশ কিছু নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে এর ফল পেতে শুরু করে দেশটি। সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে। মূলত এই দুটুিপদক্ষেপের ফলেই ঘুরতে শুরু করে অর্থনীতির চাকা। বিশ্লেষকরা মএন করএছন, এখনো তাদের লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতার আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় এখনকার ছদ্ম সেনাশাসনই চলতে থাকবে।
একই সাথে ডলার ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুনে এক হাজার কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে চলতি বছরের একই সময়ে আমদানি প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। তবে পর্যটন থেকে আয় গত জুলাইয়ের চেয়ে তিন গুণ বেড়েছে। বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ও বেড়েছে। তবে সামাজিক সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এখনো কম। শ্রীলঙ্কায় ‘আইএমএফ ট্র্যাকার’ নামে একটা ওয়েবসাইট আছে, যেখানে আইএমএফের নির্দেশাবলির বাস্তবায়ন সম্পর্কে নজর রাখা হয়। সেখানে যে কেউ দেখতে পাবেন, সরকার এক বছরে আইএমএফের কাছে যেসব অঙ্গীকার করেছে, তার ৩৮ শতাংশ মাত্র পূরণ করেছে। অবশ্য মার্চের মধ্যে কর-রাজস্বকে জিডিপির ২ দশমিক ১ ভাগ করা এবং জুনে ৪ দশমিক ৩ ভাগে উন্নীত করার অঙ্গীকার এখনো পূর্ণ হয়নি।
সবমিলিয়ে সংকট একেবারে কেটে গেছে এমনটা বলা উচিত হবে না। দেশটির ৪১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ দেনা নতুন করে কবে-কীভাবে দিতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তাদের ভরসা ভারত ও চীনের দয়া। একই সঙ্গে চীন-ভারতকে সুখী করা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো ছোট দেশের পক্ষে সহজও নয়। আইএমএফ থেকে প্রথম দফা ঋণ পেতে ভারত জামিনদার হয়েছিল। দ্বিতীয় দফা ডলার পেতে চীন আইএমএফকে আশ্বস্ত করলেই তা আশার কারণ হবে। তারা সমপ্রতি বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ পেয়েছে। জুন মাসের শেষে ৫৮০ কোটি বা ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পুনর্গঠন করেছে দেশটি। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ২ বছর আগে যারা ঋণখেলাপির খাতায় ঢুকে গিয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশটি। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এ ঋণ পুনর্গঠনসংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। ভারত, জাপান ও ফ্রান্সের কাছ থেকে যে ঋণ তারা নিয়েছিল, তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। অবশ্য সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা দাবি করেছিলো।
সংস্কার না হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির আশাব্যঞ্জক পরিসংখ্যান ছাড়া টেকসইভাবে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র মতো বড় আকারে আর কিছু ঘটেনি। অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার এখনো ঘটেনি। শ্রীলঙ্কা থেকে গত কয়েক বছরে শুধু আর্থিক দুর্দশা আর আন্দোলনের খবর আসছিল। এখন শোনা যাচ্ছে, দেশটির ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ আর ‘প্রবৃদ্ধিতে ফেরা’র গল্প। আন্দোলন আর সংকটময় অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে অতীত থেকে ঘুরে দাঁড়াবে দেশটি, এমনই প্রত্যাশা।