দেড় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৭৩.৪৯%

ইসমাইল আলী: কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলেছে। ডলারের বিনিময়হার বৃদ্ধি, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এর মূল কারণ। এতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। মাত্র দেড় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৭৩ শতাংশ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও চলতি অর্থবছরের ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার দাম কমতে থাকায় আগামীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমতে পারে।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৩০ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট টাকা ৫৪ পয়সা। আর চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৯৩ পয়সা। অর্থাৎ দেড় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েছে চার টাকা ৬৩ পয়সা তথা ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় (আমদানিসহ) সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ৪৭০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ছয় টাকা ৩০ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় জলবিদ্যুতে। এক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে প্রায় তিন টাকা। এছাড়া গ্যাসে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় তিন টাকা ২৭ পয়সা, কয়লায় আট টাকা ৬৯ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর ও বায়ু) ১২ টাকা ৩৪ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১২ টাকা ৩৮ পয়সা এবং ডিজেলে ৫২ টাকা ৯৪ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়েছিল পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা।

২০২১-২২ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (আমদানিসহ) আট হাজার ৩৯৩ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ৫৪ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় দুই টাকা ৭০ পয়সা, গ্যাসে তিন টাকা ৪৭ পয়সা, কয়লায় ১২ টাকা ৬৮ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ১২ টাকা ৮৫ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১৬ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ডিজেলে ৩৪ টাকা ৩৬ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয় ছয় টাকা ছয় পয়সা।

মূলত ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তুলনামূলক বেশি চালানোয় গত অর্থবছর ওই খাতে গড় ব্যয় অনেকটা কমে আসে। আর গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চলে। এতে গ্যাসে গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বাড়তে থাকায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি ব্যয় পড়ে বেশি। এছাড়া কয়লা আমদানিতে শুল্ককর আরোপ করা হয়। এতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

এদিকে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর ছয় মাসে নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) চার হাজার ৩১৮ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ১৯৯ কোটি দুই লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়েছে ১০ টাকা ৯৩ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়েছে দুই টাকা চার পয়সা, গ্যাসে চার টাকা ১৬ পয়সা, কয়লায় ১৬ টাকা ৭২ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ১৪ টাকা ৩১ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১৯ টাকা ৯২ পয়সা এবং ডিজেলে ৩২ টাকা ২৮ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়েছে সাত টাকা ৬০ পয়সা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চলেছে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস। এতে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে ফার্নেস অয়েল ও কয়লা আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে। একই কারণে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কারণ দেশটি থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া নতুন বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়ে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একাধিক সদস্য জানান, বিদ্যুৎ খাত ভুল পরিকল্পনায় ওপর পরিচালিত হচ্ছে। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দেড় বছরে অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে দাম বাড়িয়েও ভর্তুকির চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে জনগণের কাঁধে দামের বোঝা চাপছে, অন্যদিকে পিডিবির লোকসান তথা সরকারের কাঁধে ভর্তুকির চাপ বাড়ছে।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বাদ দিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে গেছে সরকার। এতে উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন চাহিদা না থাকলেও নতুন নতুন কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। আবার জ্বালানি সংকটে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনও করা যাচ্ছে না। ফলে গড় ব্যয় বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অপ্রয়োজনীয় ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কম ব্যয়ের কেন্দ্র বেশি পরিচালনা করতে হবে। তবেই উৎপাদন ব্যয় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০