দেশি পোশাকের ঐতিহ্য ঘিরে নরসিংদীর অর্থনীতি

সময়ের সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প। রাজধানীর চারপাশে বিভিন্ন এলাকার নামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘শিল্পাঞ্চল’ শব্দটি। পুরোনো-নতুন খাতে বিনিয়োগকে ঘিরে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য বাড়ছে। এতে উম্মুক্ত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার, তৈরি হচ্ছে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান। রাজধানীর আশেপাশের এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

পলাশ শরিফ: ‘শেখেরচর বাবুরহাট’। নরসিংদী সদরের শেখেরচরে প্রায় ৩০০ বছর বয়সী হাটটি দেশের কাপড়ের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করছে। ওই হাটকে কেন্দ্র করে এখনও সগৌরবে টিকে আছে নরসিংদীর তাঁতশিল্প। তবে সময়ের ব্যবধানে পোশাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা।
নরসিংদীর দেশীয় পোশাকশিল্পের শুরু ও বিকাশের পেছনে বেশকিছু চমকপ্রদ গল্প রয়েছে। সামন্ত যুগের জমিদার হলধর সাহা ওরফে কালু সাহা তাঁতের কাপড় পছন্দ করতেন। তাই স্থানীয় তাঁতিদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের তৈরি তাঁতের কাপড় বিক্রি শুরু করেন। জমিদার হলধর সাহার হাতে গড়ে ওঠে আজকের স্বনাম খ্যাত শেখেরচর বাবুরহাট। ধীরে ধীরে দূর-দূরান্ত থেকে পাল তোলা নৌকায় করে সওদাগররা ওই হাটে আসতে থাকেন। তখন ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে পানসী ভিড়িয়ে জমিদাররাও শখ করে সওদা করতে আসতেন।
কালক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলের কাপড় ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে নৌপথে বাবুরহাটে আসতে শুরু করেন। তৎকালীন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নরসিংদীতে তৈরি কাপড় পাঠাতে শুরু করেন। এভাবে নরসিংদীর কাপড়ের পরিচিতি ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীর ডাকে বিদেশি বস্ত্র বর্জন শুরু হলে যোগীদের পাশাপাশি ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষও তাঁতের কাপড় বুননে উৎসাহী হয়ে ওঠে। বিশ্বখ্যাত মসলিনও দেশি পোশাকের তালিকায় ছিল।
বিগত কয়েক দশকে নরসিংদীর অর্থনীতিতে গতি আনতে জেলাজুড়ে তিন লক্ষাধিক তাঁত কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে প্রায় সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া জেলায় প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ও ভারী শিল্প গড়ে উঠেছে। এর সিংহভাগই পোশাক শিল্প-কারখানায় ব্যবহƒত যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম তৈরি-বিপণনের সঙ্গে জড়িত। সময়ের সঙ্গে উৎপাদিত পোশাকেও ভিন্নতা এসেছে। এখন লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা-তোয়ালে, শাড়ি, থ্রিপিস, বিছানার চাদর, শীতের পোশাক ও লেপ-তোশকের কাপড়সহ সব ধরনের কাপড়ই এখন নরসিংদীতে তৈরি হচ্ছে।
শেখেরচর বাবুরহাট বণিক সমিতি সহ-সভাপতি আবদুল বারিক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কাপড় উৎপাদনকারী তাঁতি থেকে শুরু করে পাইকারি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা পর্যন্ত সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নরসিংদী দেশের মানুষের কাপড়ের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। দেশে অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। আর দেশি পোশাকের বাজারের কেন্দ্রবিন্দু এখন বাবুরহাট। ৩০০ বছরের পথপরিক্রমায় নানা উত্থান-পতন হলেও আধুনিকায়নের কারণে নরসিংদীর পোশাকশিল্প তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আগে হাতেবোনা তাঁত ছিল। এখন পাওয়ার লুম এসেছে। সময়ের সঙ্গে ব্যবসায়ও পরিবর্তন এসেছে। জনপ্রিয় অনেক ব্র্যান্ড হারিয়ে গেছে, আবার নতুন ব্র্যান্ডও এসেছে। তারপরও সার্বিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।’
নরসিংদীর পোশাকশিল্প আর ‘শেখেরচর বাবুরহাট’ একসূত্রে গাঁথা। প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা ওই হাটে ছোট-বড় পাঁচ হাজারের বেশি পাইকারি কাপড়ের দোকান রয়েছে। সপ্তাহে বৃহস্পতি থেকে শনিবার পর্যন্ত হাট বসে। এ হাটে প্রতি সপ্তাহে গড়ে দেড় হাজার কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হয়। নানা উৎসবের সময় লেনদেন আরও বেড়ে যায়। তখন দৈনিক লেনদেন এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে বছরে তিন থেকে চার মাস ব্যবসায় কিছুটা মন্দা থাকে। অবশ্য তখনও দৈনিক লেনদেন ৫০০ কোটির ওপরেই থাকে। কাপড়, উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী, ক্রেতা, আড়তদার, কর্মচারী-শ্রমিক ও কুলি-পরিবহন শ্রমিক মিলিয়ে কয়েক লাখ মানুষ এ হাটের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে দিন দিন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে হাটটি।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বর্তমান মাধবদীতে বাবুরহাটের উত্তর দিকে আনন্দী গ্রামে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ‘কাজীরহাট’ নামে একটি হাট বসত। সেই হাটে তখনকার দিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিকিকিনি হতো। হাটের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন জমিদার আশু বাবুর সঙ্গে ঝগড়ার জেরে তার ভাই কালী বাবু, প্রমথ বাবু ও গোপাল বাবু শেখেরচরে ‘নতুন বাবুরহাট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তাদের বাড়ির আঙিনায় সপ্তাহের প্রতি সোমবার হাট বসতে শুরু করে। মাধবদী ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে কিছু লোক গর্ত খুঁড়ে হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে কাপড় উৎপাদন করত। ওই কাপড় মাধবদীর সাপ্তাহিক হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসত। সেই হাটটিই কালক্রমে ওই জেলার অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১