তোফাজ্জল হোসেন: বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা ও আবেগের সূর্যোদয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এই মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার, দেশীয় পত্রপত্রিকা-সংবাদমাধ্যম, প্রবাসী বাঙালি এবং বিশ্বের একাধিক দেশ থেকে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত নিয়মিত-অনিয়মিত পত্রপত্রিকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা-বর্বরতা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুদর্শা, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে ছিল। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ অসংখ্য পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-সম্পাদকীয়, কবিতা-গান, প্রবন্ধ-কার্টুন প্রভৃতি মাধ্যমে পাকিস্তানিদের নির্মম-নৃশংসতার নিন্দা-ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানায়। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত হয়, জনমনের প্রত্যাশা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক হয়। বিগত দিনে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় সংবাদপত্র-গণমাধ্যমগুলো বিশেষ অবদান রেখেছে। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদকীয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবাণী পত্রিকা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরে এর বিচার দাবি করে। এছাড়া স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, সোনার বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, নতুন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, অগ্রদূত, আমার দেশ, অভিযান, মুক্তি, দুর্জয় বাংলা, বাংলার মুখ, জš§ভূমি, সাপ্তাহিক বাংলা, দাবানল, স্বাধীন বাংলাসহ অনেক দেশীয় সংবাদমাধ্যম নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের ‘চরম পত্র’ এবং তেজোদ্দীপক গান-কবিতা, রম্য রচনা এ দেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তৎকালীন দেশীয় পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার শিরোনামের কথা না বললেই নয়। ১৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ‘বাঙালীরা নতি স্বীকার করিবে না: মুজিব’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। অন্যদিকে ১৯ মার্চ, দৈনিক ইত্তেফাকে পত্রিকায় ‘এ গণবিস্ফোরণ মেশিনগানেও স্তব্ধ করা যাইবে না’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। প্রিন্ট মিডিয়ার এমন শিরোনাম মানুষের মনকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে, তা অবলীলায় বলে দেয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জাতি সব রকমের আক্রমণের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়গুলোর ওপরও জোর দেয়। যেমন ২১ মার্চ দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় সব জেলার আন্দোলন, বিক্ষোভের সংবাদগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পর পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি পত্রিকা এবং রাজাকার আলবদর কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোই প্রকাশ পায়। সেই সময়ে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ প্রকাশ করে যুদ্ধের টুকরো টুকরো অসংখ্য খবর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিংবা তার আগে পত্রিকাগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে। তারাও মেধা আর কলম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সে সময়কার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। কিন্তু তাদের কথা ইতিহাসে খুব একটা উঠে আসে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার বাঙালির জনচৈতন্যকে যেভাবে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ ও ঐকমত্য তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল তা কি বিস্মৃত হওয়ার? তখনকার নির্ভীক সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজও মাইলফলক হিসেবে চিহ্নমান। অন্যদিকে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যমের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ইয়াহিয়া খানের ডায়ালগ নাটক প্রভৃতি ঘটনা, ২৫ মার্চের ‘সার্চলাইট’ নামের গণহত্যার খবর দেশ-বিদেশে প্রচার করে বিদেশি সাংবাদিকরা। বৈদেশিক গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য জানতে পেরেছিল। তাদের প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে রেডিও’র বিভিন্ন খবর, কথিকা ও গান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয় এবং সাহস দিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করেছে। অন্যদিকে বিবিসি’র সংবাদকর্মী মার্ক টালির মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিডনি শনবার্গ, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, সাইমন ড্রিং, অ্যালেন গিন্সবার্গ, নিকোলাস টোমালিন, মার্টিন গুনাকাট, জন পিলজার, ডেভিড, পিটার হাজেন হার্স্ট প্রমুখ সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করেন। এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মান, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রকৃত ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করে। তাদের সাহসিকতা ও সংবাদের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমের কয়েকটি শিরোনামের দিকে নজর দেয়া যাক। সাল ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে থাকাকালে অবস্থায় ২৫ মার্চের গণহত্যার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে। পুলিশ সদর দপ্তর, ছাত্রাবাস, দোকানপাটে নির্বিচারে হত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাঙালি জনগণ যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তা গত সপ্তাহে বেদনাদায়ক এক গণহত্যার মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। এই দুঃস্বপ্ন ভুলতে তাদের কয়েক প্রজš§ লেগে যাবে। ১৮ এপ্রিল, লন্ডনের দ্য অবজারভার গণমাধ্যমে ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে, ছাত্রহত্যা এবং লেখক ও সাংবাদিক হত্যার খবর ছাপে। ১২ এপ্রিল, নিউজউইক ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদ ছাপে। এছাড়া ১৩ জুন, দি সানডে টাইমস ‘গণহত্যা’ নামে ১৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন ছাপে যার লেখক ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে ‘দি উইকলি নিউএজ’ পত্রিকা ২৬ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবাদপত্রে একাত্তর বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। ইতিহাসের সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পর্ক অতি নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। ইতিহাসচর্চা কিংবা রচনা দুটি ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা কিংবা বোঝার জন্য তৎকালীন সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক। প্রকৃতপক্ষে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অধিকন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস-মনোবল-শক্তি সঞ্চার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস এতটাই ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিস্তৃত যে, জনগণ-রাজনৈতিক দল-ব্যক্তি, বেসামরিক-আধা সামরিক-সামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী-গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিক, নারীসমাজ সবারই যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও ভূমিকার নিদর্শন রয়ে গেছে। আর এ সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে সংবাদপত্রে। যে কাল যে যুগই হোক না কেন, সময় ও ইতিহাস রক্ষিত আছে সংবাদে।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়