মুরগির খামার করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন বগুড়ার তিন শতাধিক যুবক-যুবা। পড়ালেখা সম্পন্ন করে তারা কর্মসংস্থানের অভাবে এক সময় চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। এখন তাদের মুখ থেকে যেন হাসি সরছে না। কারণ, তারা নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি পরিবারের সচ্ছলতাও ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন।
শিক্ষিত যুবক জাকারিয়া হোসেন। শিক্ষাজীবন শেষে দীর্ঘদিন চেষ্টা-তদবির করেও চাকরি জোটাতে পারেননি। এজন্য অনেক ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। একপর্যায়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে সেসব দুঃসহ দিন এখন অতীত। বর্তমানে জাকারিয়া একজন সফল খামারি।
তিনি স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শে অভাব ও বেকারত্ব ঘুচাতে জীবনযুদ্ধে সঙ্গী করেছেন দেশি মুরগি পালনকে। এজন্য যুক্ত হন ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি’ নামের একটি খামার সংঘে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ধড়মোকাম গ্রামের বসতবাড়িতে গড়ে তোলেন ক্ষুদ্র পরিসরে দেশি মুরগির বাণিজ্যিক খামার। অল্পদিনের মধ্যে সফল হন তিনি। স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারেও আসে আর্থিক সচ্ছলতা। তাই মাত্র ৫০টি মুরগি নিয়ে শুরু করা খামারটিতে বর্তমানে আট শতাধিক দেশি মুরগি রয়েছে। চার বছরের ব্যবধানে ব্যবসার পরিধি বাড়ায় শূন্য থেকে লাখপতি বনে গেছেন জাকারিয়া।
কেবল জাকারিয়াই নন, তার মতো এ উপজেলার প্রায় ৩০০ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবা ভেটেরিনারি সার্জনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগির (অরগানিক) খামার গড়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব খামারের সঙ্গে যুক্ত থেকে আরও পাঁচ হাজারের অধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে।
একাধিক খামার পরিদর্শনকালে কথা হয় সুবর্ণা খাতুন নামের এক নারী খামারির সঙ্গে। তিনি বলেন, সার্জন স্যারের পরামর্শে দেশি মুরগির খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছি। হতাশাগ্রস্ত বেকার জীবনকে ছুটি দিয়েছি। আবদুস সালাম নামের আরেক খামারি বলেন, শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিই। কিন্তু চাকরি নামের সোনার হরিণ পাইনি। এতে হতাশ হয়ে পড়ি। বোঝা হয়ে যাই পরিবারের। প্রতিনিয়ত নানা কটুকথা শুনতাম। তাই কুপথে পা বাড়াই হাতে তুলে নিই মাদক। একদিন হঠাৎ সার্জন স্যারের সঙ্গে দেখা। তার পরামর্শে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসি। বসতবাড়িতে একটি দেশি মুরগির খামার গড়ে তুলি। অল্পদিনের মধ্যে খামারটি লাভজনক হয়ে ওঠে। এখন প্রতি মাসে খামার থেকে অর্ধলাখ টাকা আয় করছি। ফলে সংসারে সচ্ছলতা আসায় সুখ-শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারছি।
এ জাতের মুরগির সংরক্ষণ ও বিস্তার ঘটলে দেশে নিরাপদ ও প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ হবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি তা জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দফতর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে পৌরসভাসহ উপজেলার ১০ ইউনিয়নে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগির খামারের কার্যক্রম শুরু হয়। এ জাতের মুরগির (অরগানিক) খামারের উদ্যোক্তা ভেটেরিনারি সার্জন মো. রায়হান। তার সার্বিক সহযোগিতায় দ্রুততম সময়ে এখানে গড়ে ওঠে তিনশতাধিক খামার। খামারিদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি’ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনের মাধ্যমে চাকরি না পাওয়া যুবক-যুব মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশি মুরগির খামার গড়তে উদ্বুদ্ধ করছেন। ফলে এ ধরনের খামারের সংখ্যা বাড়ছে।
সূত্র আরও জানায়, উপজেলায় মোট খামারি রয়েছেন ৩৫০ জন। তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা ১০০ এবং পুরুষ ২৫০ জন। সবাই শিক্ষিত। ক্ষুদ্র ও বড় পরিসরে খামার করে সবাই আজ স্বাবলম্বী। এতে পরিবার ও সংসারে এনেছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। ভেটেরিনারি সার্জন ডা. রায়হান নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের হতাশাগ্রস্ত বেকারদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত তহবিল থেকেও সহযোগিতা করেছেন।
ডা. রায়হান বলেন, খাতটি সম্ভাবনাময়। স্বল্প বিনিয়োগে চাকরির বিকল্প কর্মসংস্থানের নতুন খাত হিসেবে দেখছি একে। পাশাপাশি ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি’ সংঘের সামাজিক ইতিবাচক কার্র্যক্রমের মাধ্যমে যুবসমাজকে মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, বাল্যবিবাহ ও যৌন হয়রানির মতো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রেখে কর্মমুখী করতে কাজ করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী শেখ বলেন, ভেটেরিনারি সার্জন
রায়হান একজন দক্ষ কর্মকর্তা। তার এ দেশীয় মুরগির খামার যেন মডেল হিসেবে সারা দেশে বিস্তৃতি লাভ করে, সেজন্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ডা. রায়হানের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও সহযোগিতায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক দেশীয় মুরগির খামার এরই মধ্যে লাভজনক হিসেবে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। তাই তার এসব খামার মডেল হিসেবে সারা দেশে চালুর জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে সুপারিশ পাঠানো হবে।
পারভীন লুনা, বগুড়া