রহমত রহমান: দেশীয় সিগারেট কোম্পানির বেশিরভাগ এখন গ্রুপ অব কোম্পানি। তামাক ব্যবসার আয় থেকে গড়েছেন পুঁজি। সেই পুঁজি পাচার না করেই তা দিয়ে দেশে গড়েছেন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সৃষ্টি করেছেন লাখো মানুষের কর্মসংস্থান। ফলে সিগারেটসহ অন্যান্য খাতে দেশীয় মালিকদের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। তবে দেশীয় মালিকদের সেই আদি ব্যবসা আজ ধ্বংসের মুখে। নীতি সহায়তার অভাবে শতভাগ দেশীয় ২৬টি সিগারেট কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। মাত্র ১০ শতাংশ বাজার রয়েছে দেশীয় মালিকদের হাতে। আর ৯০ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে একটি বহুজাতিক কোম্পানি। শতভাগ দেশীয় সিগারেট কোম্পানিকে বাঁচাতে সরকার ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুটি পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু অজানা কারণে সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আগামী অর্থবছর সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন দেশীয় মালিকরা।
দেশীয় সিগারেট কোম্পানিদের সংগঠন লোকাল ওন্ড সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার মালিক সমিতির তথ্যমতে, সিগারেট খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রাজস্ব আদায়ে ২০০২-০৩ অর্থবছরে চারটি মূল্যস্তর (প্রিমিয়াম, উচ্চমান, মধ্যম মান ও নিন্মস্তর) করা হয়। সে সময় বহুজাতিক কোম্পানি প্রিমিয়াম, উচ্চমান ও মধ্যম মান এবং দেশীয় কোম্পানি নিন্মসø্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করত। তবে বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) ও শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি ছিল বহুজাতিক কোম্পানি কখনও নিন্মসø্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করবে না। এর ফলে দেশীয় সিগারেট কোম্পানির ব্যবসার প্রসার ঘটে। কিন্তু বিএটিবি কথা রাখেনি। ২০০৬-০৭ সালের দিকে নিন্মসø্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করা শুরু করে। এর ফলে দেশীয় কোম্পানি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
তথ্যমতে, বিএটিবি দেশীয় কোম্পানির মালিকদের এবং সরকারকে দেয়া বিভিন্ন সময়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ২০০৬-০৭ অর্থবছরের শেষের দিকে হঠাৎ করে নিন্মসø্যাবের সিগারেট বাজারজাত শুরু করে। তখন দেশীয় কোম্পানির আপত্তির কারণে তারা কম পরিমাণ সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করবে, এমন অঙ্গীকার করে। কিন্তু পরে আগ্রাসী বিপণনের মাধ্যমে গোল্ড ফ্লেক, পাইলট ও ব্রিস্টল সিগারেট ব্র্যান্ড দ্রুততম সময়ে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করে।
হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৬-০৭ অর্থবছর বিএটিবির বাজার ছিল শূন্য আর শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির বাজার ছিল শতভাগ। এর পরের অর্থবছর থেকে বিএটিবি’র বাজার বাড়তে থাকে, কমতে থাকে দেশীয় কোম্পানির বাজার। ২০০৭-০৮ অর্থবছর যেখানে বিএটিবি’র বাজার হয় তিন শতাংশ, দেশীয় কোম্পানির ৯৩ শতাংশ, সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছর বিএটিবি ৮৪ শতাংশ আর দেশীয় কোম্পানি (একটি বহুজাতিক কোম্পানিসহ) মাত্র ১৬ শতাংশ।
বিএটিবি হলিউড, ডারবি, পাইলট ও রয়্যাল প্রভৃতি ব্র্যান্ডের সিগারেট উচ্চমূল্যে বিক্রয়ের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও বিএটিবি দেশীয় সিগারেটশিল্পকে ধ্বংস করার জন্যই নামি ব্র্যান্ডগুলো নিন্মস্তরে উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় মূল্য পার্থক্য কিংবা এ ব্র্যান্ডগুলো মধ্যমমানে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।
সূত্র জানায়, সরকার শতভাগ দেশীয় কোম্পানির বিনিয়োগ সুরক্ষায় ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাজেটে দুটি মূল্যস্তর সৃষ্টি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর দেশীয় কোম্পানির জন্য নিন্মসø্যাব সংরক্ষিত রেখে বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে মধ্যমমানে উন্নীত করে। কিন্তু অজানা কারণে সরকারের নেয়া সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
সরকারের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নেয়া সেই পদক্ষেপ আগামী ২০২২-২৩ বাজেটে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে দেশীয় মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির সংগঠন লোকাল ওন্ড সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার মালিক সমিতি।
দেশীয় সিগারেট মালিকরা বলছেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে নীতিকৌশল অবলম্বন করা হলে সরকার সিগারেট খাত থেকে বর্তমানের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি রাজস্ব পাবে। আর দেশীয় সিগারেট ব্র্যান্ড নিন্মস্তর সুরক্ষিত হবে। প্রথম প্রস্তাবে নিন্মসø্যাবের দুটি স্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রতি ১০ শলাকার ৩৯ টাকার সিগারেট শুধু শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির জন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আর নিন্মস্তরের অপর ১০ শলাকার ৪৭ টাকা মূল্যের সিগারেট বিদেশি মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির জন্য। নি¤œস্তরের দুটি ব্র্যান্ডের সম্পূরক শুল্ক হবে ৫৭ টাকা করে। মধ্যম মানের প্রতি ১০ শলাকার দাম হবে ৭৩ টাকা। আর উচ্চমানের প্রতি ১০ শলাকার একটি ১১৩ টাকা ও অপরটি ১৪৮ টাকা। তিনটি ব্র্যান্ডের সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ টাকা।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, নি¤œসø্যাব শুধু দেশীয় মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির জন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। যাতে বলা হয়, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আদায় হবে প্রায় ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি।
নি¤œসø্যাবের সিগারেটের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ানোর ফলে দেশে চোরাচালান, নকল ও ব্যবহƒত ব্যান্ডরোলের ব্যবহার করে সিগারেট বাড়ানোর প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, নিন্মসø্যাবের সিগারেটের দাম ক্রমাগতভাবে ১১ বছরে প্রায় ৬৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে সীমান্ত ও বন্দর দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সিগারেট দেশের বাজারে প্রবেশ করছে।
বর্তমান সিগারেট খাতের বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরে সংগঠনের প্রতিনিধি ইকবাল আনোয়ার শেয়ার বিজকে বলেন, মোট বাজার হিস্যার ৯০ শতাংশ একটি বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। দেশীয় কোম্পানি হিসেবে আমরা শুধু নিন্মমানের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকি। এ সেগমেন্টে আমাদের সম্মিলিত বাজার হিসাব মাত্র ১০ শতাংশ। সংগত কারণেই দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত ব্র্যান্ড অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে এবং আমাদের টিকে থাকার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশীয় কোম্পানির অস্তিত্ব রক্ষায় সরকার ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে দুটি যুগান্তরকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দুটি সিদ্ধান্তের মধ্যে যেটি দেশীয় শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে, তা বাস্তবায়ন করার জন্য জোর দাবি জানান তিনি।