ইসমাইল আলী: গত কয়েক বছরে দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়েছে। মহাসড়ক ছাড়াও গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ। এতে গ্রামীণ এলাকায় নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। তবে দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনও রয়ে গেছে সড়ক সুবিধার আওতার বাইরে। বর্তমানে এর পরিমাণ এক কোটি ৫৯ লাখ, বিশ্বে যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। এ তালিকার শীর্ষ তিন দেশই হলো আফ্রিকার।
বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০১৮: ফ্রম ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। জনসংখ্যার ঘনত্ব, নগরায়নের হার, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা ও গ্রামীণ অবকাঠামো ইনডেক্সের ভিত্তিতে এক্ষেত্রে সড়ক নেটওয়ার্ক যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের আটটি দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। দেশগুলোর জনসংখ্যা ৪৬ কোটি ১৭ লাখ। আর সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৪২ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ছয়টিই আফ্রিকা মহাদেশের। বাকি দুটি দক্ষিণ এশিয়ার। কমপক্ষে দুই কিলোমিটার পথ নৌকায় বা হেঁটে গিয়ে প্রধান সড়কে উঠতে হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে ও শহরে যাতায়াত করতে হয়।
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সড়ক সুবিধাবঞ্চিত ইথিওপিয়ার জনগোষ্ঠী। দেশটির ছয় কোটি ৩৭ লাখ মানুষের যাতায়াতে প্রধান সড়ক ব্যবহারের সুযোগ পায় না। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তানজানিয়া। দেশটির তিন কোটি ২৮ লাখ মানুষ সড়কের সুবিধাবঞ্চিত। তৃতীয় অবস্থানে থাকা উগান্ডার এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ সড়কের সুবিধাবঞ্চিত।
আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশগুলোর পর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের এক কোটি ৫৯ লাখ মানুষ সড়ক নেটওয়ার্ক সুবিধার বাইরে রয়েছে। সড়ক নেটওয়ার্কের সুবিধাবঞ্চিত শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত আরও দুই দেশ মোজাম্বিক ও কেনিয়া। দেশ দুটির যথাক্রমে এক কোটি ৫০ লাখ ও এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। তালিকায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে পার্শ^বর্তী দেশ নেপাল। দেশটির এক কোটি তিন লাখ মানুষ সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। আর অষ্টম অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া। দেশটির ৬৯ লাখ মানুষ সড়ক ব্যবহারের সুবিধাবঞ্চিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামছুল হক এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, সড়ক অবকাঠামো খাতে প্রতি বছর প্রচুর বিনিয়োগ হলেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগের পরিকল্পিত ব্যবহার হয় না। অনেকটা অ্যাডহক ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে কী ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই যাচাই করা হয় না। ফলে এত বিনিয়োগের পরও দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের গত বছর প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অধীনে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬৮১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ পাকা সড়ক। সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার সওজের অধীন। আর বাকি তিন লাখ চার হাজার ৩৭৯ কিলোমিটার ফিডার বা গ্রামীণ সড়ক। এর মধ্যে মাত্র ৫৩ হাজার ৩১৬ কিলোমিটার ভালো অবস্থায় আছে।
এতে আরও বলা হয়, দেশের সবচেয়ে কম সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে খাগড়াছড়িতে। এরপর রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও সুনামগঞ্জ জেলায়। আর বর্তমানে দেশে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে সড়কের পরিমাণ ১৯২ কিলোমিটার। তবে এ দেশের জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় মাথাপিছু সড়কের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
এদিকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মাথাপিছু সড়কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ রয়েছে তলানিতে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি হাজার মানুষের জন্য সড়ক রয়েছে মাত্র দশমিক ১০ কিলোমিটার। অথচ মালদ্বীপে প্রতি হাজার মানুষের জন্য সড়ক রয়েছে দশমিক ৩০ কিলোমিটার, নেপালে ৮০, পাকিস্তানে এক দশমিক ৫০, আফগানিস্তানে এক দশমিক ৬০, ভারতে তিন দশমিক ৫০, শ্রীলঙ্কায় পাঁচ দশমিক ৫০ ও ভুটানে ৯ দশমিক ৭০ কিলোমিটার।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট সড়কের মাত্র ১০ শতাংশ পাকা; যেখানে আফগানিস্তানে পাকা সড়ক ২৯ শতাংশ, ভুটানে ৪০, ভারতে ৫০, নেপালে ৫৪, পাকিস্তানে ৭২ ও শ্রীলংকায় ৮১ শতাংশ। আর মালদ্বীপের শতভাগ সড়কই পাকা।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের গ্রামীণ অবকাঠামোর পরিকল্পিত উন্নয়নে নতুন কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সড়কগুলোর ডিজাইন গাইডলাইন নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বুয়েটকে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বেশকিছু সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে। আবার এগুলোর ভারবাহী ক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। আর নতুন বেশকিছু সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো সম্পন্ন হলে দেশের শতভাগ মানুষকে সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যাবে।

Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 10:00 am
দেশের এক কোটি ৫৯ লাখ মানুষ এখনও সড়ক সুবিধাবঞ্চিত
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: