দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও মাগুরার কুমড়ো বড়ি

নামটি শুনতে বেখাপ্পা মনে হতে পারে ডালের কুমড়ো বড়ি। যে কোনো ডাল ও পাকা চালকুমড়ো দিয়ে বানানো যায় বলে এর নাম ডালের কুমড়ো বড়ি। মাগুরাসহ বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু তরকারি এটি। বর্তমানে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি হচ্ছে এই বড়ি। মাগুরার অনেক এলাকায় এটা ব্যণিজ্যিকভাবে তৈরি হয়। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরে এই বড়ি রাজধানীতে চলে আসে। পরে তা রফতানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
মাগুরা সদর উপজেলার বাটিকাডাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি। স্থানীয়দের কাছে কুমড়ো বড়ির গ্রাম নামেও পরিচিত এসব গ্রাম। বাটিকাডাঙ্গা গ্রামের আরাধনা দাস (৬৫), শান্তি রানি দাস (৩৮) ও শান্তুনাথ দাস (৪৫) প্রতিদিন প্রায় ২০ কেজি বড়ি বিক্রি করেন বাজারে। শান্তুনাথ দাস জানান, অতীতে বাটিকাডাঙ্গা গ্রমের ৫০ থেকে ৫৫টি পরিবার কুমড়ো বড়ির ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় এ বছর এ সংখ্যা বেড়ে ৬০ থেকে ৭৫টি পরিবার এ কাজে নিয়োজিত হয়েছে। মো. পারভেজ জানান, এ ব্যবসায়ের কল্যাণে অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে গেছে।
ভাদ্র থেকে ফাল্গুনÑএই সাত মাস ধরে চলে বড়ি বেচাকেনা। বছরের বাকি সময় তারা অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মো. মতলেবুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্রে মাগুরার ডালের কুমড়ো বড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমি প্রতি বছর ২০ কেজির বেশি কুমড়ো বড়ি নিয়ে যাই।
এই ব্যবসায়ের ওপর ভর করে একসময়কার ভূমিহীন অনেক পরিবার জমি কিনে পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করেছে। বলা যায়, সচ্ছলতার আলো এসেছে অনেক পরিবারে। কুমড়ো বড়ির সঙ্গে জড়িত সব পরিবারের সন্তানেরা পড়ালেখা করছে।
মাগুরা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের একটি গ্রামে দেখা যায়, কুমড়ো বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে প্রায় সব বাড়ির আঙিনায় রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ মনোরমা পাল (৭৩) বলেন, একসময় চার আনা সেরে মাষকলাইয়ের ডাল ছিল। আর বড়ি বিক্রি হতো ১২ আনা সের দরে। সেই বড়ি এখন বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। প্রদীপ ভৌমিক জানান, এক কেজি বড়ি বানাতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। খুচরা বাজারে এর দাম ২০০ থেকে ২১০ টাকা। আমরা খুচরাই বেশি বিক্রি করি। এতে লাভ বেশি। অনেকে এই কুমড়ো বড়ি দেশের বাইরে আত্মীয়স্বজনের জন্য পাঠিয়ে থাকে।
কুমড়ো বড়ির পাইকারি ব্যবসায়ী মো. খাইরুল ইসলাম জানান, মৌসুম শুরুর আগে প্রবাসীরা টাকা পাঠিয়ে অর্ডার দিয়ে রাখেন।
যে কোনো ডাল ও পাকা চালকুমড়ো দিয়ে কুমড়ো বড়ি বানানো যায়। তবে মাষকলাইয়ের ডাল ও পাকা কুমড়োর তৈরি বড়ির জুরি মেলা ভার। এখন মাষকলাইয়ের দাম বেশি হওয়ায় অ্যাংকর ডালের বড়ি বেশি বানানো হয়। বেলা রানী ভৌমিক, বীণাপাণি, বিজলী রানী, আদরি রানী, মনোরমা পাল ও হেলেনা বেগম জানান, ডাল পরিষ্কার করে ধুয়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাটায় ভালো করে বেটে পাকা কুমড়োর সঙ্গে হাত দিয়ে ফেনানোর পর কালোজিরা, সাদাজিরা ও গুয়ামুরি দিয়ে দিনের প্রথম ভাগে বড়ি বানিয়ে টিনের পাত্রে রেখে রোদে ভালো করে শুকানো হয়। নিখিল চন্দ্র পাল বলেন, প্রায় ১৬ বছর কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করছি। প্রতি হাটে দুই ভাই মিলে প্রায় ১২০ কেজি বড়ি বিক্রি করি। বর্তমানে ডালের দাম বেশি হওয়ায় আগের চেয়ে লাভ একটু কম পাই। আমির আলী বলেন, পাঁচ থেকে সাত বছর আগে আমরা ১০ থেকে ১২টি পরিবার কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করতাম। এখন ৭০ থেকে ৮০টি পরিবার এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছি।
মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম মো. গোলাম মওলা বলেন, তরকারি হিসেবে কুমড়ো বড়ি অতুলনীয়। একসময় বউ-ঝিরা বাড়িতে শখ করে বড়ি বানাতেন। আর এখন এটা অনেক পরিবারের প্রধান আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।

মো. ইমাম জাফর

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০