মো. আসাদুজ্জামান নূর: ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনায় বড় ধাক্কা খেল দেশের পুঁজিবাজার। প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক কমেছে ১০৯ পয়েন্ট বা দেড় শতাংশের বেশি, যা চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পতন। বছরের শুরু থেকেই উত্থানে থাকা ডিএসইতে এর আগে ৩১ ডিসেম্বর ও ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ ৬৫ পয়েন্ট করে সূচক হ্রাস পেয়েছিল। বড় পতন হয়েছে অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)।
বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রির চাপেই ধস নেমেছে পুঁজিবাজারে। অনেকে বিনিয়োগকারী মজা করে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বোমা ডিএসইতে বিস্ফোরিত হয়েছে, যার কারণে ডিএসই লণ্ডভণ্ড।’
গতকাল ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে দফায় দফায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পূর্ব ইউরোপের এ দেশটিতে রাশিয়ার হামলার জোরালো আশঙ্কার মধ্যেই কিয়েভে এ বিস্ফোরণের খবর আসে। গতকাল পুঁজিবাজারের লেনদেনের শুরুতেই এ হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে, যার কারণে আতঙ্কিত হয়ে শুরু থেকেই শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন তারা।
লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, প্রথম ১৩ মিনিটে সূচক বেড়ে লেনদেন হয়। সকাল ১০টা ১৩ মিনিটে সূচক আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেড়ে অবস্থান করে ছয় হাজার ৯৭০ পয়েন্টে। এর পরে সূচক পড়লেও সকাল সাড়ে ১০টায় আবারও উত্থানের চেষ্টায় ছিল। তবে প্রচণ্ড বিক্রয় চাপের কারণে তা আর ঊর্ধ্বমুখী হতে পারেনি।
দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ১০৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ছয় হাজার ৮৩৯ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ২২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ৪৭৫ পয়েন্টে এবং ব্ল–চিপ সূচক বা ডিএস৩০ সূচক ৩৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে দুই হাজার ৫১৪ পয়েন্টে।
দেখা যায়, সূচক পতনের মূলে ছিল বড় কোম্পানিগুলোর বড় দরপতন। এদিন গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জহোলসিম, রবি, পাওয়ার গ্রিড ও ওরিয়ন ফার্মার মতো বড় কোম্পানিগুলোর ব্যাপক মূল্য হ্রাসে সূচক কমেছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের তিন দশমিক আট শতাংশ মূল্য হ্রাসে সূচক হারিয়েছে ২৮ দশমিক ৮৭ পয়েন্ট।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় এক মাস ধরে বড় বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এরই মধ্যে গতকাল রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এ খবরে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাজার আরও পড়বে বলে গুজবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে। ফলে দিন শেষে ভয়াবহ দরপতন হয়েছে।
এ বিষয়ে এক্সপো ট্রেডার্সের শীর্ষ কর্মকর্তা শহিদুল হোসেন বলেন, এ পতনের প্রধান কারণ আতঙ্ক। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের বিচলিত করে তোলে। তারা ধরে নিয়েছিলেন যে, এ যুদ্ধের কারণে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে। বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম মন্দার দিকে চলে যাওয়ার বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পুঁজি হারানোর চেয়ে শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকেছেন তারা।
গতকাল লেনদেন হওয়া ৩৭৭টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৩০টির। ২১টি কোম্পানি দাম ধরে রাখতে পেরেছে। এর বিপরীতে ৩২৬টি বা ৮৬ শতাংশের বেশি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য পতন হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রির কারণে এমন দরপতনেও লেনদেনে বেশি হয়েছে ডিএসইতে।
ডিএসইতে হাতবদল হয়েছে এক হাজার ৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট, যা আগের কার্যদিবসের চেয়ে ১৬২ কোটি ৪২ লাখ টাকা বেশি। বুধবার লেনদেন হয়েছিল ৮৮৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার।
লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব খাতেই শেয়ার বিক্রির হিড়িক ছিল। এজন্য লেনদেনে প্রত্যেক খাতেরই ভালো অংশগ্রহণ ছিল। তবে বস্ত্র, ওষুধ ও রসায়ন, বিবিধ এবং প্রকৌশল খাতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে। তবে অন্যান্য খাতেও তুলনামূলক লেনদেন হয়েছে।
এছাড়া সিংহভাগ কোম্পানির দরপতনে সব খাতেই ব্যাপক দরপতন দেখা গেছে। এর মধ্যে আশা জাগানিয়া ছিল বস্ত্র খাত। এ খাতের ২৫ শতাংশের মতো কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বাইরে সিমেন্ট ২৮, মিউচুয়াল ফান্ড ১৪ ও করপোরেট বন্ড খাতের ৫০ শতাংশ কোম্পানির মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে পুঁজিবাজারের এমন পতনে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফরিদ ফজল নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘পুঁজিবাজারে আসুন, নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করুন। আমি আপনাদের পুঁজির নিশ্চয়তা দেব। বাণীটা কার ছিল?’ এখন পুঁজির নিশ্চয়তা কে দেবে এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
রসিকতা করে মাসুম জামান নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘রাশিয়ার বোমা ডিএসইতে বিস্ফোরিত হয়েছে, যার কারণে বাজার লণ্ডভণ্ড।’
অন্যদিকে পুঁজিবাজারের এমন পতনে আতঙ্কিত না হয়ে সুযোগ নিয়েছেন কেউ কেউ। নাসরিন আক্তার নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের আতঙ্কের সুযোগে পছন্দের কিছু শেয়ার অনেক কম দামে কিনে নিলাম।’
অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩৩২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯৮১ পয়েন্টে। সিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ৩০৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ২৪৭টির আর অপরিবর্তিত ছিল ২৫টির। এদিন সিএসইতে লেনদেন হয় ৩৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকার। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার।