নিজস্ব প্রতিবেদক; সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ এক দফা দাবিতে গতকাল শনিবার সারাদেশে পদযাত্রা করছে বিএনপি। এতে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ও মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের বাধার সম্মুখীন ও হামলার শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
গতকাল বিকাল সোয়া ৪টার দিকে সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর সেতুর ঢালে জেলা বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশ লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট ছুড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি কর্মীরা। এসময় বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর পাল্টা ইট-পাটকেল ছোড়েন।
পুলিশ জানায়, বিনা অনুমতিতে মহাসড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করছিল বিএনপি। মহাসড়ক ছেড়ে দিতে বললে তারা পুলিশের ওপর চড়াও হন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, কেন্দ্রীয় পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাশের ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জড়ো হতে শুরু করেন জেলা বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় পুলিশ মহাসড়ক থেকে সরে যেতে বললে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে তর্ক বাধে। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে বিএনপি নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়লে বিএনপি কর্মীরা ইট-পাটকেল মারতে থাকেন।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তারা শান্তিপূর্ণভাবে পদযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় সোনারগাঁ থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। পরে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকন বলেন, ‘কাঁচপুর সেতুর ঢাল থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।’
পুলিশ বলছে, বিনা অনুমতিতে মহাসড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং বিশৃঙ্খলা এড়াতে তাদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা বলেন, ‘পদযাত্রা করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি ছিল না। বিএনপি নেতাকর্মীরা মহাসড়ক অবরোধ করে যান চলাচলে বিঘœ তৈরি করছিলেন। পুলিশ তাদের মহাসড়ক ছেড়ে দেয়ার কথা বললে উল্টো চড়াও হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অ্যাকশনে যায়।’
‘পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোড়া হলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। পরবর্তী বিশৃঙ্খলা এড়াতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে,’ যোগ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
অপরদিকে গতকাল দুপুরে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা সেতু এলাকা থেকে পদযাত্রা নিয়ে বের হয়ে নেতাকর্মীরা এলজিইডি অফিসের সামনে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে সেখানেই বিএনপি নেতাকর্মীরা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি আব্দুর রউফ সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পদযাত্রা কর্মসূচিতে পুলিশের বিরুদ্ধে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে মানিকগঞ্জে জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা বের করেছি। কিন্তু এই সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও পুলিশ দিয়ে বাধা দিচ্ছে।’
সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এ দেশের মানুষ আপনাদের আর চায় না। আপনারা যদি ক্ষমতা না ছাড়েন তাহলে দেশের মানুষ আপনাদের টেনেহিঁচড়ে নামাবে।’
জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বিএনপি শহরের এলজিইডি পর্যন্ত পদযাত্রা করার অনুমতি নিয়েছিল। সেখানে তাদের সমাবেশ করার কথা ছিল না। তবুও তারা ব্যস্ততম রাস্তা অবরোধ করে সমাবেশ করেন। তাদের কোনো বাধা দেয়া হয়নি।’
অনুমতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আফরোজা খান রিতা বলেন, ‘এলজিইডি অফিস পর্যন্ত অনুমতি নেয়া হয়েছিল। আমরা সেখান থেকে পদযাত্রা নিয়ে ফিরে আসতে চাইলে পুলিশ আমাদের বাধা দেয়।’
এদিকে বরগুনা জেলা বিএনপির পদযাত্রায় নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করার অভিযোগ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের মূল সড়কে এ ঘটনা ঘটে। বিএনপি নেতাদের দাবি, ‘পুলিশের লাঠিপেটায় অন্তত ৫০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
পদযাত্রায় অংশ নেয়া বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সকাল ১০টার দিকে বরগুনা শহরের পুরান লঞ্চঘাট এলাকায় জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ধস্তাধস্তি হয় এবং নেতা-কর্মীরা বাধা অতিক্রম করে পদযাত্রা শুরু করেন। পরে বিএনপির পদযাত্রা প্রেস ক্লাবের সামনে পৌঁছালে ফের বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বিএনপি নেতা-কর্মীরাও পুলিশের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে পুলিশের লাঠিপেটা শুরু করে এবং বিএনপির পদযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বরগুনা জেলা যুবদলের সভাপতি জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পদযাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিপেটা করে নেতা-কর্মীদের আহত করে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’
জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পুলিশকে অনুরোধ করেছিলাম, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শেষ করে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করব। কিন্তু তারা আমাদের কথা না শুনে নেতা-কর্মীদের ওপর বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে।’ এ বিষয়ে বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে। এখানে লাঠিপেটার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আর আহত হওয়ার বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূল সড়কে বিএনপির পদযাত্রার কারণে জনগণের ভোগান্তি হচ্ছিল। আমরা তাদের মূল সড়ক ছেড়ে কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার জন্য অনুরোধ করেছি। পরে তারা কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেছেন।’
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে নেত্রকোনায় জেলা বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে হাতবোমার বিস্ফোরণ ও অটোরিকশা ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ছয় নেতা-কর্মীকে আটক করার পাশাপাশি বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র জব্দ করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল সকাল ৯টায় শহরের কুড়পাড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি লুৎফুল হক।
তিনি জানান, বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী শহরের কুড়পাড় এলাকায় হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে।
এ সময় পুলিশ অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ছয়জনকে আটক করে। তারা সবাই বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
অভিযানে নাশকতার জন্যে মজুদ রাখা দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্রও জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানান ওসি।
তবে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম হিলালী দাবি করেন, শনিবার সকালে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন শেষে নেতা-কর্মীরা ফিরে যাচ্ছিলেন। এ সময় একদল যুবক কুড়পাড় এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং সেখানে ভাঙচুর চালায়। তিনি বলেন, ‘এটি পরিকল্পিতভাবে বিএনপির ওপর দোষারোপ করা হচ্ছে। এতে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন।’
হবিগঞ্জে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে থানার ওসিসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। গতকাল বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলা শহরের শায়েস্তানগর এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিকালে পদযাত্রা কর্মসূচির আয়োজন করে বিএনপি। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে উভয়পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হলে শহরে আতঙ্ক দেখা দেয়।
সংঘর্ষ চলাকালে প্রধান সড়কের এক দিক থেকে বিএনপি নেতাকর্মী ইটপাটকেল ছুড়ে এবং অন্যদিক থেকে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।
হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি অজয় চন্দ্র দেবসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এবং বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিতে দেখা গেছে।
জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘পদযাত্রা কর্মসূচির শেষ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ভেতরের রোডে যেতে বলে পুলিশ। কিন্তু বেশি মানুষ জড়ো হওয়ার কারণে ভেতরের রোডে জায়গা না হওয়ায় প্রধান সড়কে ভিড় ছিল। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে বিএনপি নেতাকর্মীরা পাল্টা আক্রমণ করে। ’
সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন এবং কী পরিমাণ টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়েছে, জানতে চাইলে হবিগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান বলেন, ‘এসব বিষয়ে পুলিশ পরে কথা বলবে।’