দেশের মধ্যে নিউজিল্যান্ড

খন্দকার এম কায়েদুজ্জামান: নিত্যদিনের ব্যস্ততা থেকে একটু মুক্তি পেয়েই আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে রওনা দিয়েছি খাগড়াছড়ির উদ্দেশে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থান এ জেলার। খোদ জেলা শহরের আশপাশে রয়েছে অসাধারণ কিছু দর্শনীয় স্থান। এসব কিছু দেখার জন্য ঢাকা থেকে রাতে বাসে রওনা দিই। খুব ভোরে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরে নেমে পড়ি। বাসে বসে দেখতে থাকি সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো। পাহাড়ি বাঁকে যখন ড্রাইভার বিশাল বাসটা ঝড়ের গতিতে ঘোরায় তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। তবে আমরা বেশ উপভোগ করি পথটুকু।

খাগড়াছড়ি শহরে নেমে একটা হোটেলে উঠে পড়ি। নাস্তা সেরে পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করে ফেলি।

প্রথমে চলে যাই আলুটিলা সুড়ঙ্গে। বাসে চড়ে আলুটিলা সুড়ঙ্গে যেতে মাত্র ১০ মিনিট সময় লাগে। চান্দের গাড়ি, মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিতে করেও যাওয়া যায়। আলুটিলায় নেমে মশাল আর টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এখান থেকে পিচঢালা পাহাড়ি রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পাই দীর্ঘ একটা সিঁড়ি। এটি গিয়ে শেষ হয়েছে একেবারে আলুটিলা সুড়ঙ্গের মুখে। ঝটপট মশালগুলো জ্বালিয়ে ঢুকে পড়ি সুড়ঙ্গের ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর সুড়ঙ্গের নিচে বয়ে যাওয়া বরফশীতল পানির স্পর্শ রোমাঞ্চিত করে আমাদের। সুড়ঙ্গের তলাটা মসৃণ নয়, ছোট বড় অসংখ্য পাথরে ভর্তি। একটু অসাবধান হলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। কিছুক্ষণ হাঁটলে দেখতে পাই সুড়ঙ্গটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটা গেছে বামদিকে, আরেকটা ডানদিকে। ডানেরটা কিছুদূর গিয়ে শেষ হয়েছে কানাগলির মতো। বামের সুড়ঙ্গটা ধরে এগোতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পর দূরে একটা সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পাই। এটা সুড়ঙ্গের অন্য মুখ। সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে পাহাড় বেয়ে আলুটিলার চূড়ায় উঠে আসি। এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বাড়িঘরগুলো দেখতে বিন্দুর মতো মনে হয়। দূরে পেঁজা তুলার মতো ভাসমান সাদা মেঘ।

আলুটিলা থেকে বাসে চড়ে প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই রিসাং ঝরনায়। ঝরনার কাছাকাছি গিয়ে শুনতে পাই পানির কলধ্বনি। কিছুদূর এগিয়ে দেখি পাকা সিঁড়ি নেমে গেছে একেবারে ঝরনার পাদদেশ পর্যন্ত। রিসাং ঝরনার গেট থেকে সামনের দিকে ১৫ মিনিট হেঁটে অপু ঝরনার কাছে চলে যাই। অনেকের কাছে এটা রিসাং-২ নামে পরিচিত। এ ঝরনায় নামতে হয় একটা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে। ঢালের শেষে থাকা গিরিপথ ধরে এগোতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা খোলা উদ্যানে এসে পৌঁছাই। উদ্যানের একপাশে ওপর থেকে ঝিরঝির শব্দে বইছে অপু ঝরনা, আরেক পাশে মিহি পাথরের খোলা উদ্যান। ক্যাম্পিংয়ের জন্য চমৎকার এ স্থান।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি অবস্থিত পানছড়ি শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। আমরা সিএনজি ভাড়া করে সেখানে চলে যাই। মাহেন্দ্র গাড়িতে চড়েও যাওয়া যায়। গৌতমবুদ্ধের মূর্তি ছাড়া এখানে রয়েছে ছোট ছোট আরও অনেক কুটির, আছে সুজাতা, সুঘলায়ন, চারিপুত্র ও আনন্দ চাকমার মূর্তি। প্রতিবছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান।

শান্তিপুর অরণ্য কুটির থেকে বের হয়ে পানছড়ি রাবার ড্যামে চলে যাই। ভারত থেকে নেমে আসা চেঙ্গী নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে রাবারের তৈরি বিশাল বড় একটা টিউব। তাতে বাতাস ভরে নিয়ন্ত্রণ করা হয় পানির গতিপথ। বাঁধের ওপর একটা উঁচু সেতু রয়েছে। রাবার ড্যামের স্বচ্ছ পানির স্পর্শ, আর পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ছুটে আসা দমকা হাওয়ায় দেহ মন জুড়িয়ে নিই।

পরের গন্তব্য মাটিরাঙ্গা শতবর্ষী বটগাছ। খাগড়াছড়ি শহর থেকে বাসে প্রায় বিশ মিনিটের পথ। আমরা মাটিরাঙ্গা ১০ নম্বর রিজিয়নে নেমে পড়ি। সেখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে চলে যাই বটগাছের কাছে। চাইলে মোটরসাইকেলে চড়েও যেতে পারেন। অনেকের মতে গাছটির বয়স প্রায় চারশ বছর। কথিত আছে, এ বটের ছায়ায় বিশ্রাম নিলে আয়– বাড়ে। বটের ছায়ায় তাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিই খাগড়াছড়ি শহরের উদ্দেশে।

সেদিনের মতো ঘোরাঘুরি শেষ করি। পরেরদিন চলে যাই দেবতা পুকুরে। নুনছড়ি ত্রিপুরা গ্রামে এর অবস্থান। লোকাল বাস কিংবা সিএনজিতে করে আমরা প্রথমে চলে যাই মাইচছড়ি। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে এ পুকুর। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কাছে এটি তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। তারা পুকুরটাকে ‘মাতাই পুখির’ বলে ডাকেন। মাতাই অর্থ দেবতা, পুখির মানে পুকুর। কথিত আছে, স্বয়ং দেবতা এসে এ পুকুর খনন করে গেছেন। এ কারণে পাহাড়ের এত ওপরে থাকা সত্ত্বেও এর পানি শুকায় না।

খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খাগড়াছড়ি হেরিটেজ পার্ক। অটো নিয়ে চলে যাই পার্কে। পার্কের ওপর থেকে খাগড়াছড়ি শহরটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে। এখানে একটা ঝুলন্ত ব্রিজ ও ছোট একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। সেখানে কাটিয়ে দিই বিকালটুকু।

নিউজিল্যান্ড পাড়ায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন ধরে। এবার সরাসরি সেখান থেকে ঘুরে আসি। সবুজ ফসলের ক্ষেত দূরে গিয়ে মিলেছে উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়ের ওপরটা ছেয়ে আছে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘে। আকাশের নীল যেন আরেকপ্রস্থ তুলি চালিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের একমাত্র সমতল ভূমিটাকে পরিণত করেছে এক টুকরো নিউজিল্যান্ডে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে পানখাইয়া পাড়া থেকে আপার পেরাছড়া গ্রামের দিকে যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। এ রাস্তাটাকে বলে নিউজিল্যান্ড সড়ক। মূলত নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিল আছে বলে একে স্থানীয়রা নিউজিল্যান্ড পাড়া বলে ডাকে।

খাগড়াছড়ি শহর থেকে অল্প দূরে অবস্থিত কুমিল্লা টিলা। কুমিল্লা টিলা হচ্ছে বিজিবি ব্যাটালিয়নের ক্যাম্প। আমরা অনুমতি নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঘুরে বেড়িয়েছি। সাজানো গোছানো ক্যাম্পের চারপাশ। সেখানে আছে ফুলের বাগান আর বসার স্থান।

খাগড়াছড়িতে থাকাকালীন পাংখাইয়া পাড়ার সিস্টেম রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করি। খাগড়াছড়ি শহর থেকে অটোবাইকে চড়ে এ রেস্টুরেন্টে যেতে মাত্র ১০ মিনিট লাগে। একটা মারমা পরিবার রেস্টুরেন্টটা চালায়। এখানে তুলনামূলক কম দামে থানকুনি ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, মরিচ ভর্তা, আপ্রেং, লাউ-চিংড়ি, কলার মোচা, মাশরুম, কাঁঠাল তরকারি, বাঁশ তরকারি, লইট্টা মাছের স্টেক, মুরগিসহ ৩০-৪০ পদের তরকারি খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি তিন দিন।

প্রভাষক, সিএসই ডিপার্টমেন্ট , মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০