দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের কাছে বন্দি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের জাতীয় সংসদ ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের ক্লাবে পরিণত হচ্ছে। সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব সব সময়ই ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের ৫৬ শতাংশ সদস্যের পেশা ব্যবসা। এভাবে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিপতিদের দখলে চলে যাচ্ছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের একটি অধিবেশনে বক্তারা এ কথা বলেন। দুদিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে। গতকাল সম্মেলনের সমাপনী দিনে ‘দ্য পাওয়ার ডাইনামিক্স বিটউইন স্টেট অ্যান্ড বিজনেস: হাউ ইজ ক্যাপিটালিজম ইভলভিং ইন বাংলাদেশ?’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।

অধিবেশনটিতে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান। আলোচক ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশে এক ধরনের লুণ্ঠনের সংস্কৃতি জড়িত। এই লুণ্ঠন প্রথম শুরু হয় স্বাধীনতার পর। ওই সময় একটি শ্রেণি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে ধনী হয়েছে। এরপর বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলো থেকে নানা কৌশলে অর্থ সরিয়ে নিয়ে একটি গোষ্ঠী অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে একটি শ্রেণি পুঁজিপতি হয়ে উঠেছে। এসব পুঁজিপতি শ্রেণি পরে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়ে বিভিন্ন নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক বন্দবস্ত না হলে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা টেকসই করে তোলা যাবে না। কী ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারেÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজনে নানা সময়ে আমরা এ ধরনের রাজনৈতিক বন্দবস্ত দেখেছি। এসব সমঝোতা সৃষ্টিতে রাজনৈতিক এলিটের বাইরে সামাজিক এলিট শ্রেণিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টিতে সামাজিক এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আগামী দিনেও এ ধরনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট আসতে পারে।

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, গত ১০-১৫ বছরে দেশে এক ধরনের সামাজিক শক্তি তৈরি হয়েছে। তারা রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ায় নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছেন ব্যবসায়ী নেতারা। দেশ টেকসই উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে না। এজন্য দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ খুবই জরুরি বলেন ড. দেবপ্রিয়। 

তিনি আরও বলেন, আগে দেখতাম বাজার পরিস্থিতি ব্যর্থ হয়েছে, ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে, এখন দেখছি এলিট শ্রেণিও ব্যর্থ হচ্ছে। এই পদ্ধতিটা চালু থাকলে একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার প্রচলন ঘটতে পারে। এই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কি টেকসই হবে? এটার ক্রন্তিকাল এরই মধ্যে চলে এসেছে। যে সংস্কারগুলো আমাদের করার কথা, সেগুলো আইএমএফ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

আশিকুর রহমান বলেন, দেশের রাজনীতিতে  প্রতিযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি তৈরি হওয়ার মূল কারণ নির্বাচনে অংশ নিতে বিপুল পরিমাণের অর্থ ব্যয়ের সংস্কৃতি তৈরি হওয়া। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট মেম্বার পদে নির্বাচন করার জন্য একজন প্রার্থীর ব্যয় হয় সাকুল্যে এক থেকে দেড় লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা এক থেকে দেড় কোটি টাকার মতো। অথচ ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রর্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য দেড় কোটি টাকার ওপরে ব্যয় করতে হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা এমন ব্যয়বহুল হয়ে গেলে তো রাজনীতিতে পুঁজিবাদের আধিপত্য বাড়তে বাধ্য।

নজরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পুঁজিপতিদের প্রভাব বেড়েই চলেছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও পুঁজিপতি শ্রেণির হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থা কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় পাঁচতারা হোটেলে। পুঁজিপতিরা গভর্নরকে সেখানে ডেকে নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। আবার পুঁজিপতিদের হস্তক্ষেপে সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ থামিয়ে দিয়ে এলএনজি আমদানির নীতিতে ঝুঁকে পড়ল। ফলে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া যে সঠিক ছিল না, তা এখন প্রমাণিত হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০