Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:11 am

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

সংগীত কুমার: দেশে অফশোর ব্যাংকিংকে আইনগত ভিত্তি দিয়ে এই বিশেষ ধরনের ব্যাংকিংসেবার প্রসার ঘটানোর কার্যক্রম বেশ দ্রুতগতিতেই এগিয়ে চলেছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মতো সীমিত পরিসরের ব্যাংকিং সার্ভিস আইনের মাধ্যমে চালু করে একটি দেশের আর্থিক খাত এবং অর্থনীতি যে এত ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে, তা গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত প্রায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান স্থিতিশীল অর্থনীতিকে দেখলে বোঝা যায়। আমরা জানি, দেউলিয়াত্বের দারপ্রান্তে চলে যাওয়া পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল তিন বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সেই পরিস্থিতি থেকে দেশটি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ নামের একটি ব্যাংক সেবার মাধ্যমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশের অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক সীমিত পরিসরে অফশোর ব্যাংকিং চালু রাখলেও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। এই প্রথম সরকার এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে যা জাতীয় সংসদে ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪’ নামে পাস হয়েছে। উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কেননা কোনো ব্যবসা যদি করতেই হয়, তাহলে সেটি আইনের মধ্যে থেকেই করা ভালো। বাংলাদেশ অফশোর ব্যাংকিংকে আইনগত ভিত্তি দিয়ে এই সেবার প্রসার ঘটিয়ে বহুমাত্রিক সুবিধা নিশ্চয়ই ঘরে তুলতে পারবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

অফশোর ব্যাংকিং হলো যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিদেশি সূত্র হতে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সৃষ্টি হয় এবং দেশীয় আইন-কানুনের বাইরে আলাদা আইন-কানুনের মাধ্যমে এই তহবিল পরিচালিত এবং হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। অফশোর ব্যাংকিংয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিকের নিজের দেশ ব্যতীত অন্য কোনো দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা রাখার পদ্ধতি। মোটকথা অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভ্যন্তরে পৃথক একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। প্রচলিত ব্যাংক বা শাখার কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্ন অফশোর ব্যাংকিং। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান এবং বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। এতে স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয়। এটি এমন ব্যাংকিং আপারেশনগুলোকে নির্দেশ করে যা শুধু অনিবাসীদের যেমন : মাল্টিন্যাশনাল পণ্য এবং সেবা এবং ফাইন্যন্সারদের সম্পৃক্ত করে এবং এটি দেশীয় ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুুক্ত হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে নতুন যে আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট ও এলসি খোলার সংকট সমাধানসহ বিদেশি বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে বলে আশা করছি। অফশোর ব্যাংকিং আইন প্রণয়নের স¡পক্ষে যে যুক্তিটি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি। এ কথা ঠিক যে এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রিজার্ভ বৃদ্ধির যুক্তি জাদুর মতো কাজ করতে পারে। কেননা দেশে ডলার সংকট বিরাজ করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একসময়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আইন প্রণয়ন যত সহজে সম্ভব, তা অন্য কোনো ক্ষেত্রে হবে না।

বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংক নীতিমালা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ে অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদ। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। এই খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধু লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে উনচল্লিশটি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশি বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে।

অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশি বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে। বিদেশে যে বাংলাদেশি বসবাস করছেন তার পক্ষ থেকে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তার অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। পাঁচ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা – ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়।

আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো কর দিতে হবে না। একই সাথে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার উপর কোনও কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্যও কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না। অনুমোদিত আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি, এতে যে কোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোনো লাভ দেওয়া হয় না। তবে নতুন আইনে লাভ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

নতুন অফশোর ব্যাংকিং আইনে সুবিধা অবারিত করার মাধ্যমে দুটি বিশেষ সুবিধা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এর একটি হচ্ছে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ এবং আরেকটি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ গ্রহণের সুযোগ। তবে দুটি ক্ষেত্রেই সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত কিছু ঝুঁকির বিষয় আছে যা সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমাদের দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এক বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানিমূল্য দেশে না আসার তথ্য ওঠে এসেছে। এই বিপুল পরিমাণ পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে অফশোর ব্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কেননা অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে অর্থ জমা রাখলে সেই অর্থ কোনো রকম পূর্বানুমতি ব্যতিরেকেই বিদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। ফলে যেসব অনিবাসী বাংলাদেশি অবৈধভাবে অর্থ বিদেশে নিয়ে রেখেছেন, তাদের অনেকেই সেই অর্থ দেশের অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে রাখতে আগ্রহী হবেন। তবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে অফশোর ব্যাংকিং সুযোগ খুব একটা কাজে লাগানো যাবে না। কারণ এই অর্থ বিদেশের কোনো ব্যাংক হিসাবে থাকার পরিবর্তে দেশের কোনো ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে থাকবে এবং পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে সুযোগমতো বিদেশে ফিরে যাবে।

অফশোর ব্যাংকিং সুবিধা অবারিত করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ গ্রহণ ও অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কেননা বিশ্বে যাদের হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিযোগের জন্য আছে, তারা এ রকম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাদের খুব অল্প সুদে বৈদেশিক তহবিল সংগ্রহের সুযোগ আছে। ফলে সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কিছু অধিক সুদে অর্থায়ন বা ঋণদানের সুযোগ পায়, তাহলে তারা সেই সুযোগ লুফে নেয়। এ কারণেই অফশোর ব্যাংকিং চালু করে খুব সহজেই বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থায়ন বা ঋণ পেতে পারে। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই ধরনের অর্থায়ন বা ঋণ সাধারণত স্বল্পমেয়াদি বা চাহিবা মাত্র ফেরত দেওয়ার শর্তে প্রদান করা হয়। আর এ রকম অর্থায়ন বা ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে অথবা এমন খাতে বিনিয়োগ করা হলো, যেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় রেভিনিউ উপার্জনের সুযোগ নেই, তাহলে ঋণ খেলাপি বা ডিফল্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা দেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ করা প্রয়োজন।

অফশোর ব্যাংকিং আইনে সাময়িক কিছু ডলার সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি করলেও দেশে ডলার সংকট যে তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি আকার ধারণ করেছে, তা থেকে উত্তরণের সুযোগ খুবই কম। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। এজন্য ব্যাপক হারে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। প্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপক হারে অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির আওতায় আনতে হবে। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রপ্তানি করার মতো অসংখ্য অপ্রচলিত পণ্য যেমন আমাদের দেশে আছে, তেমনি বিশ্বের অসংখ্য স্থানে নতুন নতুন বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের রপ্তানি পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করতে হবে।

বিদেশের আমদানিকারক দেশে এসে রপ্তানির আদেশ দেবে, এই অপেক্ষায় বসে না থেকে বিদেশের রপ্তানিকারকের কাছে স্ব-উদ্যোগে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাকে বলে আধুনিক রপ্তানি পদ্ধতি। এর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বৈধপথে এনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মোটকথা, আমাদের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ আমদানির চেয়ে বেশি না হলেও সমান রাখতেই হবে। এটি করতে পারলে ডলারের চাহিদা স্বাভাবিক হবে এবং মূল্যও স্থিতিশীল থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সে পথেই অগ্রসর হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।