Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:11 pm

দেশে আসেনি রপ্তানির ১৭৫ কোটি টাকা

রহমত রহমান: শতভাগ পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান আল মুসলিম গ্রুপ। ১৬ বছর আগে বন্ড লাইসেন্স নেয়। যদিও শুল্ককর সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ ওঠে। একাধিকবার এ-সংক্রান্ত অভিযোগ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু নিরীক্ষায় কখনও কোনো ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়নি। অভিযোগ পড়তেই থাকে। শেষে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এনবিআরের করা ২৯ ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম ওঠে প্রতিষ্ঠানটির।

এবার উদ্ঘাটিত হলো কোম্পানিটির শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি। পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি হলেও বিশাল অঙ্কের যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফিরে আসেনিÑতা বেরিয়ে আসে। আল মুসলিম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান একেএম নিটওয়্যার লিমিটেডের বিরুদ্ধে শুল্ককর ফাঁকি ও মুদ্রা দেশে প্রত্যাবাসিত না হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন এনবিআরে দেওয়া হয় বলে সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি বন্ড সুবিধার কাঁচামালের অপব্যবহারকারী ২৯ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে এনবিআর। এসব প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষা করতে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটকে এনবিআর নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে সাভারের উলাইল কর্ণপাড়া গেড্ডা এলাকার প্রতিষ্ঠান একেএম নিটওয়্যার লিমিটেড অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত হিসাব নিরীক্ষা করতে বলা হয়।

প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের তিনটি লিয়েন ব্যাংকের কাছে কাগজপত্র চেয়ে শুল্ক মূল্যায়ন গত এক বছরে ১৮ বার চিঠি দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অসহযোগিতা করা হয়। বারবার তদবিরের মাধ্যমে নিরীক্ষা বাধাগ্রস্ত করা হয়। এছাড়া ব্যাংক থেকে নিরীক্ষা কর্মকর্তারা আমদানি-রপ্তানির নানা তথ্য চাইলেও প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংক অসযোগিতা করে। পরে প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য এবং এনবিআরের কাছে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। নিরীক্ষা শেষে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে গত ৫ জানুয়ারি এনবিআরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, নিরীক্ষা কমিটি গত ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালে বন্ড লাইসেন্স পায়। প্রতিষ্ঠানটি বন্ডেড সুবিধায় সব ধরনের ওভেন কাপড় আমদানির মাধ্যমে শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেট উৎপাদন করে। প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা মেয়াদে ডিটেইলস প্যাকিং লিস্ট, কাপড় ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির ডেলিভারি চালান, স্থানীয়ভাবে আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাক টু ব্যাক এলসি, পিআই, মূসক-১১ চালানসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এছাড়া রপ্তানির তথ্য চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে এবং এনবিআরের কাছে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি ১০৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৫১ হাজার ৬৪৪ কেজি কাপড় আমদানি করেছে, যার শুল্ককর প্রায় দুই কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এসব কাপড় কীভাবে ব্যবহার করেছে এবং পণ্য রপ্তানি করেছে কি না, তার প্রমাণ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিরীক্ষা মেয়াদে ৭২০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৬৫ হাজার ৯৯ কেজি আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি আমদানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যার শুল্ককর প্রায় ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এসব দ্রব্যাদির ব্যবহার বা রপ্তানির কোনো কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানটি দেখাতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে দুটি ইউডির মাধ্যমে বন্ড সুবিধায় ৫৭ হাজার ২৪১ গজ কাপড় আমদানি করে, যার শুল্ককর প্রায় ১৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। নিরীক্ষা মেয়াদে এসব কাপড়ের বন্ডিং উত্তীর্ণ হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠান শুল্ককর পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটির মোট ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার শুল্ককর ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করে। নিয়ম অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসার কথা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত দুই কোটি ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৮০ ডলারের (১৭৫ কোটি ৪৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৭ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। এক হাজার ৪৪১টি শিপিং বিলের বিপরীতে এ মুদ্রা দেশে আসার কথা। এ মুদ্রা দেশে আসেনি। নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠান তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। তবে প্রতিষ্ঠানের লিয়েন ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে গত ৯ ডিসেম্বর স্বাক্ষরবিহীন একটি আমদানি-রপ্তানি বিবরণী সরবরাহ করা হয়, যা নিরীক্ষা কমিটি গ্রহণ করেনি। প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে এ বিবরণী দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে রপ্তানির আড়ালে প্রতিষ্ঠানটি এ টাকা পাচার করেছে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রত্যাবাসিত না হওয়ার তথ্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে সংশ্লিষ্ট বন্ড কমিশনারেটের মাধ্যমে কারণ দর্শানো নোটিস জারি করতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আমদানি-রপ্তানির ভুল বিবরণী দেওয়ায় ওই ব্যাংকে কারণ দর্শানো নোটিস জারি এবং শুল্ককর ফাঁকি দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আল মুসলিম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ’র মোবাইলে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক ফিরোজ আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। আমাদের কাছে যে কাগজ চেয়েছে আমরা সব সাবমিট করেছি। আমরা কাগজ দিয়েছি, তারা দেখছে না। তাদের সঙ্গে আমাদের একটু ঝামেলা আছে। তারা মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে।’

আপনারা কাগজ দিতে ব্যর্থ হয়েছে কি না এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ১১৩টি ফেব্রিক্স ও ৮০০ এক্সেসরিজের বিল অব এন্ট্রি চেয়েছে, আমরা তা দিয়েছি। আমাদের কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে, সব দিয়েছি; আমাদের কোনো শটফল নেই। যদি শটফল থাকে তা তাদের বোঝার ভুল।’ শুল্ক মূল্যায়ন থেকে আপনাদের কাছে ১৮ বার চিঠি দিয়ে কাগজ চেয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সঠিক নয়।’

রপ্তানি করা হলেও টাকা দেশে আসেনিÑএ বিষয়ে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের নয়, ব্যাংকের কাছে তথ্য চেয়েছে। এক বছরের তথ্য দু’দিনের মধ্যে চাইলে ব্যাংক দিতে পারবে? রপ্তানির টাকা দেশে না এলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে না? একটা ইএক্সপি পেইন্ডিং থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জবাব দিতে হয়। দুই কোটি ডলারের বেশি না এলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ব্যবসা করতে দিত?’

প্রতিষ্ঠান বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মাত্র এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার শুল্ককর বের হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি সব কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পুরো বন্ডিং কার্যক্রম খতিয়ে দেখলে বিপুল শুল্ককর ফাঁকি পাওয়া যাবে। এছাড়া রপ্তানির টাকা দেশে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার বিষয়ে এনবিআর সিদ্ধান্ত নেবে।’