Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:30 am

দেশে ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্য ১২ হাজার কোটি টাকার

রহমত রহমান: ডিম শুধু যে খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছে, তা-ই নয়; এ পেশার কারণে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দারিদ্র্য দূর হয়েছে। আর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। পোলট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে প্রতিবছর ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণও বাড়ছে। হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় আট হাজার ৩৩৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ১১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল প্রায় ১২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা।

অপরদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত লেয়ার খামারের সংখ্যা ২০ হাজার ৪৬৪টি। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল এক হাজার ৫৫২ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৭১১ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৭৩৬ কোটি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ। সরকারি এ পরিসংখ্যানে ডিম বলতে পোলট্রি ডিম, দেশি মুরগির ডিম, হাঁসের ডিম, কোয়েল ও কবুতরের ডিমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, ২০২১ সালে মাথাপিছু ডিমের প্রাপ্যতা ছিল ১২১ দশমিক ১৮টি। ডিমের উৎপাদনে ছোট ও বড় খামারি মিলিয়ে বাংলাদেশে মোট যে পরিমাণ বাণিজ্যিক পোলট্রি ডিম উৎপাদিত হয়, তার মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ উৎপাদন করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচিত খামারগুলো। অর্থাৎ দেশের ৮৮ থেকে ৯০ শতাংশ ডিম আসে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামার থেকে।

বিপিআইসিসির হিসাব অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি ডিম উৎপাদন করে ডায়মগ এগ। প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ১৪ থেকে ১৫ লাখ ডিম উৎপাদন করে। এছাড়া কাজী ফার্মস ১২ থেকে ১৪ লাখ, প্যারাগন পোলট্রি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ, নর্থ এগ সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ, সিপি বাংলাদেশ সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ, আফিল এগ্রো সাড়ে তিন থেকে চার লাখ, পিপলস পোলট্রি দেড় থেকে দুই লাখ, নাবিল এগ্রো পৌনে দুই লাখ থেকে দুই লাখ, ভিআইপি শাহাদত পৌনে দুই লাখ থেকে দুই লাখ, রানা পোলট্রি এক লাখ থেকে সোয়া এক লাখ, ওয়েস্টার পোলট্রি ৪০ থেকে ৫০ হাজার এবং আজিজুল হক এগ্রো প্রায় ৫০ হাজার। বর্তমানে ডিমের উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ টাকা ৫০ পয়সা।

সূত্রমতে, আগামীকাল বিশ্ব ডিম দিবস। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত আইইসি ভিয়েনা কনফারেন্স থেকে চলতি বছর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে একটি ইতিবাচক ক্যাম্পেইন, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিমের প্রয়োজনীয়তার বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিম খেতে কোনো বয়স লাগে না। জšে§র আগে থেকেই মায়ের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে ডিমের কার্যকারিতা শুরু হয়। এরপর জীবনের প্রতিটি ধাপেই মানুষের দরকার হয় ডিমের পুষ্টি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও জীবনের বাকিটা সময় শরীরের জন্য মূল্যবান অত্যাবশ্যকীয় আমিষের চাহিদা পূরণে ডিমের কোনো

 তুলনা হয় না। ডিমকে যদি সঠিকভাবে প্রোমোট করা যায় এবং দেশের আপামর মানুষ যদি পরিমাণমতো ডিম খায়, তবে এদেশের অপুষ্টির চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে ফেলা সম্ভব। ডিমকে বলা হয়ে থাকে পরিপূর্ণ খাদ্য। সারা পৃথিবীতে মাত্র কয়েকটি খাদ্যকে সুপার ফুড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, যার মধ্যে ডিম অন্যতম। ভিটামিন ও মিনারেলে সমৃদ্ধ এমন একটি প্রাকৃতিক আদর্শ খাবার পৃথিবীতে খুব কমই আছে।

সূত্রমতে, বাজারে এখন বিভিন্ন ধরনের ভ্যালু-অ্যাডেড ডিম পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ওমেগা-থ্রি ডিম, কিডস এড, সেলেনিয়াম-সমৃদ্ধ ডিম, ফোলেট এগ ইত্যাদি। সম্প্রতি জাপানের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র (এআইএসটি) গবেষকরা এমন একটি মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছেন যে, মুরগির ডিম ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র মতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিটি মানুষের বছরে ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ছিল ১২১টির অধিক। এটি নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক সংবাদ, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এখনও ডিমের কনজাম্পশন আমাদের চেয়ে অনেক কম। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সানডে ক্রনিকলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে মাথাপিছু ডিমের কনজাম্পশন মাত্র ৩০টি বলে উল্লেখ করেছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)। তারা এ সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮০টিতে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এর চেয়েও অনেকটা এগিয়ে। ২০৩১ সাল নাগাদ ডিমের মাথাপিছু কনজাম্পশন ১৬৫টি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ২০৮টিতে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

পোলট্রি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় পোলট্রি শিল্প অনেক বড় হয়েছে। তাই বিগত কয়েক বছর থেকে আমরা পোলট্রি উন্নয়ন বোর্ডের কথা বলছি। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তার অগ্রগতি মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।  

হিসাবমতে, ডিমের বৈশ্বিক উৎপাদনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এশিয়া মহাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক ডিম উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন। পোলট্রি-বিষয়ক বিখ্যাত সাময়িকী দ্য পোলট্রি ওয়ার্ল্ডে বলা হয়েছে, গত দশকের তুলনায় এই দশকে ডিমের উৎপাদন ২৪ শতাংশ বেড়েছে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার ওরগানাইজেশনের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ডিমের উৎপাদন ছিল ৮৩ মিলিয়ন টন, যা ২০০০ সালে উৎপাদিত ডিমের চেয়ে প্রায় ৬৩ শতাংশ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীনে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ছিল ২৫৫টি এবং ভারতে ৭৬টি। সেখানে ২০২০ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ছিল ১০৪ দশমিক ২৩টি।

ডিম উৎপাদনের দিক থেকে এশিয়া এখন পর্যন্ত প্রধান উৎপাদনকারী অঞ্চল, যা ২০১৯ সালের বৈশ্বিক উৎপাদনের ৬২ শতাংশ। চীনের পরের অবস্থানে আছে আমেরিকা ২১ শতাংশ, ইউরোপ ১৩ শতাংশ, আফ্রিকা চার শতাংশ এবং ওশেনিয়া শূন্য দশমিক চার শতাংশ। ইউরোপ ছাড়া উল্লিখিত সব অঞ্চলে ডিমের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬০ শতাংশের ওপরে। মোট ৩৫ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে চীন বিশ্বে শীর্ষ মুরগির ডিম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। অন্য দেশগুলো হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, জাপান ও রাশিয়ান ফেডারেশন।