দেশে দেশে ‘আয়নাঘর’

ফাহিম ফয়সাল: বর্তমানে সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই ‘আয়নাঘর’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এটি কেবল একটি শব্দ নয় এটি অনেকের জন্য এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক যতটা নির্যাতনের কথা জানা যায়, এই আয়নাঘরের নির্যাতন তার কোনো অংশেই হয়তো কম না। অন্তত নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা এমনটাই বলে থাকেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত অধ্যাপক গোলাম আযমের মেঝো ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী এবং একই দলের সাবেক নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাশেমসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা এবং নাম না জানা অনেককেই সাবেক স্বৈরাচারী সরকার আওয়ামী লীগের আমলে গুম করে আয়নাঘরে প্রেরণের তথ্য উšে§াচিত হয়েছে। কেমন ছিল আয়নাঘর? তাদের মুখ থেকে শুনলেই বেরিয়ে আসে ভয়ানক দুর্বিষহ দিন আর রাত্রিগুলো।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাশেম প্রায় আট বছর এবং মাইকেল চাকমা প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আয়নাঘরে গুম অবস্থায় ছিলেন। সম্প্রতি কথিত আয়নাঘরের কিছু ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। যা এতদিন বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছিল। ছবিতে স্পষ্টই দেখা যায়, চতুর্দিকে দেয়ালে আবদ্ধ ছোট্ট একটি কুঠুরি যেখানে কোনো জানালা নেই। আলো প্রবেশের জন্য একদম দেয়ালের মাথার এককোণে ছোট্ট একটি গবাক্ষ। কারাগারের মতো দরজা এবং তার সামনে আরেকটি কাঠের দরজা। সেখানে কী হতো, এসব প্রশ্নের উত্তরে নির্যাতিত ব্যক্তিদের থেকে অনেক অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেছে। যেমন- কারও হাত-পা বাঁশের সঙ্গে বেঁধে মানবদোলনা বানিয়ে নির্যাতন করা কিংবা হাতের নখ উপড়ে ফেলা এবং আটক ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টা হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা ইত্যাদি। নির্যাতনের সংখ্যা ও মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যা লিখে হয়তো শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের এ আয়নাঘরে কেউ হয়তো নির্যাতনের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থেকেছেন আবার কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। এ স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মাধ্যমে এই ভয়ানক আয়নাঘর প্রথার ইতি ঘটেছে। মুক্তি পেয়েছেন নির্যাতিত অনেক নির্দোষ ব্যক্তি।
এটি বাংলাদেশের আয়নাঘর। দেশে দেশে ‘আয়নাঘর’ রয়েছে ভিন্ন নামে। চীনা সরকার মূলত এগুলোকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বলে থাকে। পূর্ব তুর্কিস্তান যাকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বর্তমানে ‘জিনজিয়াং প্রদেশ’ নামকরণ করেছে। এ অঞ্চলে বসবাস করে উইঘুর ও কাযাখ নামীয় মুসলিম জাতি। কিন্তু চীনা সরকারের অনৈতিক আগ্রাসনের ফলে তাদের অনেককেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে এ সংখ্যা ১০ লাখ হলেও কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন ৩০ লাখেরও বেশি। আমরা সবাই একটি কথিত ট্যাগ ‘জঙ্গি’-র সঙ্গে পরিচিত। মূলত প্রতিপক্ষ দমন-পীড়ন ও হিংসাত্মক রাজনৈতিক মনোভাব চরিতার্থ করার লক্ষে স্বৈরাচারী ক্ষমতাসীনরা এরূপ ট্যাগ ব্যবহার করে থাকে। তেমনি চীনা সরকারও উইঘুর মুসলিমদের তথাকথিত ‘জঙ্গি’ ট্যাগের দোহাই দিয়ে তাদের আয়নাঘর তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের নির্যাতনের মাত্রা হয় চরম ভয়াবহ। রুটিন করে নির্যাতন, ধর্ষণ, ইলেকট্র্রিক শক এবং মগজধোলাই করা হয় বন্দিদের। সেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয় তথা মুসলিম ও ইসলামকে ভুলিয়ে দিতে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। অনেককে চীনাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে শ্রমদাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। উইঘুর মুসলিমদের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে চীন সরকার এক বিশাল অর্গান ট্রেড করছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও মহিলাদের জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো এবং গণধর্ষণেরও শিকার হতে হয়েছে। বিদেশি কিছু গণমাধ্যম এই নির্যাতনের ব্যাপারে তথ্য পেলে তা অনুসন্ধানের লক্ষে চীনে গেলেও চীনা সরকার তাদের উš§ুক্তভাবে কাজ করতে বাধা দিয়েছিল। ফলে সামান্য কিছু তথ্য বেরিয়ে এলেও এখনও অনেক ভয়াবহ তথ্য অজানাই রয়ে গেছে।
আয়নাঘর আছে ফিলিস্তিনেও। দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর কারাগারগুলো এবং গোটা ফিলিস্তিনে তাদের আগ্রাসন যেন একটি আয়নাঘরে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা গেছে, ইসরাইলি সেনাদের কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের গণধর্ষণের এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সেই সেনাদের গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি তাদের এরূপ ন্যক্কারজনক কাজকেও সমর্থন জানিয়েছে নেতানিয়াহু প্রশাসন। এছাড়াও ফিলিস্তিনে নারীদের পিরিয়ড বন্ধ রাখতে ওষুধ খাওয়াতে বাধ্য করা হয়। এছাড়াও ক্ষণে ক্ষণে মিসাইল ও বোমার মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে ওঠে ফিলিস্তিনের ভূমি। নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অনেক মানুষ নিহত হন তাদের এই ভয়াবহ হামলায়।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরিকৃত আয়নাঘরের কথা বিশ্ববাসীর অগোচরে নেই। কিউবার গুয়ানতানামো কারাগার, ইরাকের আবু গারিব কারাগার এবং জর্জ ডাব্লিউ বুশ কর্তৃক আফগানিস্তানে নির্মিত বাগরাম কারাগার একেকটি ‘আয়নাঘর’। বাংলাদেশের আয়নাঘরে রহস্য গোপন থাকলেও আমেরিকানরা খুল্লামখুল্লা নির্যাতন করে।
সারা বিশ্বে নানা কায়দায় মানবাধিকার কমবেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এসব অনিয়ম-অত্যাচার রোধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পেলে তারা সাময়িক খোলস পাল্টালেও সুযোগ পেলেই মরণকামড় বসাতে পারে। পৃথিবীতে শান্তি ফিরুক নতুন প্রজšে§র হাত ধরে, সেই প্রত্যাশা সবার।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০