নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রধানত সংক্রামক রোগ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। তবে বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও খারাপ। দেশে প্রতি বছর ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতি ঘণ্টায় এ সংখ্যাটি আনুমানিক দু-তিনজন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুর জšে§র পর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্ব অনেক। এতে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি শতকরা ১৫ ভাগ কম হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। গতকাল বৃহস্পতিবার মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) ট্রেকশন কনফারেন্স হলে ‘শিশুদের নিউমোনিয়া: আমরা কি যথেষ্ট করছি?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। নিউমোনিয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর জন্য প্রধান সংক্রামক রোগ। এই রোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু।
অনুষ্ঠানে আইসিডিডিআর,বি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী প্রতিষ্ঠানটিতে নিউমোনিয়া নিয়ে তার নিজের ও ড. নুর হক আলম, ড. কে জামান এবং ড. আহমেদ এহসানুর রহমানের কয়েকটি গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বিজ্ঞানী ড. চিশতী বলেন, নিউমোনিয়া এখনও বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক রোগ। এ রোগের ফলে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ শিশুর মৃত্যু হয়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সব মৃত্যুর ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে এ পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ।
প্রতি ঘণ্টায় আনুমানিক দু-তিনজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় এবং বছরে প্রায় ২৪ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। এটি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী, যা বিশ্বব্যাপী গড় অবস্থানের চেয়েও বেশি। কয়েক দশক ধরে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে প্রতি হাজার জীবিত জšে§ প্রায় ৭ দশমিক ৪ জন শিশু মৃত্যুবরণ করেছে নিউমোনিয়ায়। পাশাপাশি প্রায় ৪০ লাখ নতুন রোগীসহ প্রতি বছর আনুমানিক ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
এসময় বাংলাদেশের শিশুদের নিউমোনিয়ার কারণগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে একটু আলাদা বলে জানান ড. চিশতী। তিনি বাংলাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের নিউমোনিয়ার পেছনে বিশেষ কারণ তুলে ধরেন। এতে ২০১৯ ও ২০২১ সালে আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি উঠে আসে। এ ফলগুলো দেখায় যে, বিরল গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া শৈশবকালীন নিউমোনিয়ার নতুন কারণ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
পরিবেশের প্রভাব ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা তুলে ধরে ড. চিশতী বলেন, ঘরের মধ্যে বাতাসের গুণগত মান উন্নত করার মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক করা সম্ভব। হাত ধোয়া ২১ শতাংশ কেস কমাতে পারে। শিশুর জšে§র প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো একটি বড় ভূমিকা রাখে। ফলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১৫ শতাংশ কমে যায়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা নিউমোনিয়াকে ফুসফুসের প্রদাহ হিসেবে বর্ণনা করে এর মূল চরিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, নিউমোনিয়ার শুরুতে কাশি হয়, যা সাধারণত দুই-চার সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি থেকে শ্বাসকষ্ট এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, অল্পবয়সী, প্রবীণ এবং যাদের হƒৎপিণ্ড বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, তাদের গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সচেতনতা ও সঠিক সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
আলোচনা সভায় ২০০৭ এবং ২০২০ সালে আইসিডিডিআর,বি’র ভ্যাকসিন নিয়ে করা গবেষণায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপযোগী হতে পারে, এমন একটি টিকা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতীদের আরএসভি ভ্যাকসিন দেয়া হলে তা নবজাতক শিশুদের গুরুতর নিউমোনিয়া এবং হাইপোক্সেমিয়া (রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা) প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ সময় নিউমোনিয়ার উপসর্গ, হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং চিকিৎসার বিষয়ে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সময়ের সচেতনতার বিষয়ে জোর দেয়া হয়।
আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, এর আগে ডায়রিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান ঘাতক হলেও বর্তমানে নিউমোনিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অনেক শিশু মারা যায়। আক্রান্ত হন প্রাপ্তবয়স্করাও এবং তাদেরও মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। আইসিডিডিআর,বি’তে নিউমোনিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, যা সফলভাবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং পরীক্ষামূলকভাবে এর ব্যবহারও করা হয়েছে। এই ফল ও পদ্ধতি মানুষের কাছে আরও সহজে পৌঁছে দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।