‘দেশে সিরামিক শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে’

নাজমুল করিম একজন সিরামিক বোদ্ধা। ব্রিজ কেমি নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই উদ্যোক্তা কেমিক্যাল, মেশিনারিজ, প্রযুক্তি ও পরামর্শ দিয়ে এ খাতের উন্নয়নে গত ২২ বছর ধরে অবদান রেখে চলেছেন। এ দীর্ঘ সময়ে নিজের মেধা, যোগ্যতা ও অধ্যবসায় দিয়ে ব্রিজ কেমিকে দেশে-বিদেশে সিরামিক খাতের একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ শিল্পের চলমান সংকট নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেন শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিদুর রহমান

শেয়ার বিজ: বর্তমানে বিশ্বে নানামুখী সংকট চলছে। এই সংকটকালীন আপনারা কেমন আছেন?

নাজমুল করিম: এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জ্বালানির সংকট। দেশে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়ায় সিরামিক কোম্পানিগুলোর উৎপাদনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। চলতি মাসে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানির  উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কেননা সিরামিক কারখানায় পণ্য প্রস্তুতে চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকতে হয়। সেই হিসেবে এই শিল্পে গ্যাস একটি অন্যতম কাঁচামাল। সিরামিক খাতে আমাদের দেশে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সংকট ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় সম্প্রতি কিছু বিদেশি কোম্পানি আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে।

শেয়ার বিজ: এলসি খোলার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে? 

নাজমুল করিম: প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে না পারায় ব্যবসা পরিচালনা করা এবং ক্রেতা ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ১০টা এলসির আবেদন করলে দুটো অনুমোদন পাচ্ছে। এ দুটির জন্যও অনেক ধরনের দেন-দরবার করতে হয়। বর্তমানে এলসি খুলতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে দেশি সিরামিক কোম্পানিগুলোর মার্কেট শেয়ার কত? গত পাঁচ বছরে মার্কেট শেয়ার কেমন বেড়েছে?

নাজমুল করিম: বাংলাদেশে আমাদের মার্কেট শেয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে আমাদের মার্কেট বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাওয়ায় আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে না। ফলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে মার্কেট প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। 

শেয়ার বিজ:  সিরামিক খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন?

নাজমুল করিম: বাংলাদেশে এখন অ্যাডভান্সড সিরামিক নেই। তবে খুব দ্রুতই সরকার উদ্যোগ নিলে এখানে অ্যাডভান্সড সিরামিক উৎপাদন হবে। যখন অ্যাডভান্সড সিরামিক পুরোপুরি চালু হবে, তখন গোটা দেশের কর্মসংস্থানেও অনেক পরিবর্তন আসবে। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিভিত্তিক। মোবাইল এক্সেসরিজ, কম্পিউটার এক্সেসরিজ, অটোমোবাইল এক্সেসরিজ থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ তৈরিতেও অ্যাডভান্সড সিরামিক ব্যবহার হয়। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, অটোমোবাইলে যে চিপগুলো ব্যবহার হয়, সেখানে অ্যাডভান্সড সিরামিক রয়েছে। অ্যাডভান্সড সিরামিক উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশে বিভিন্ন কাঁচামালও তৈরি করা যাবে। সরকার আর ব্যবসায়ীরা চাইলে বাংলাদেশকে অ্যাডভান্সড সিরামিক্সের পর্যায়ে নিতে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। এতে একদিকে বাংলাদেশে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এর জন্য প্রথমত দরকার উপযুক্ত বাজার, দ্বিতীয়ত বিনিয়োগকারী এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি। আগে চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জাপানসহ অনেক দেশ টাইলস, টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারিওয়্যার তৈরি করত। তারা এখন অ্যাডভান্সড সিরামিক ও হাইটেক সিরামিক তৈরি করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রচুর শ্রমিক রয়েছে। এখানে স্বল্প খরচেই শ্রমিক পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সিরামিক খাতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তারা অনেক দক্ষ। সিরামিক খাতের জন্য আবহাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই হিসাবে আমাদের দেশের আবহাওয়া এ খাতের জন্য বেশি উপযোগী। বর্তমানে  বাংলাদেশ যেভাবে সিরামিক পণ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে; খুব দ্রুতই বাংলাদেশ সিরামিক্সের হাব হবে। এখানে দরকার সঠিক ব্যবস্থাপনা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ শিল্প খাতে অনেক দূর এগিয়েছে।

শেয়ার বিজ: বর্তমান ব্যবসা প্রতিযোগিতামূলক। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা কেমন? পাশাপাশি বিদেশি পণ্যের তুলনায় আমাদের দেশীয় পণ্যের গুণগত মান কেমন? 

নাজমুল করিম: আমাদের দেশে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যই আন্তর্জাতিক মানের। প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারিওয়্যার রপ্তানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তবে কভিডের কারণে দুই বছর আমরা খুব বেশি বিপণন করতে পারিনি। এমনকি কোনো মেলাও করতে পারিনি। কভিড-১৯ শেষ হতে না হতেই এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে চাপে আছে। আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জ্বালানি সংকটের কারণে এসব বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানির চ্যালেঞ্জ অনেকাংশেই বেড়েছে। আমাদের দেশীয় পণ্যের মান আন্তর্জাতিক মানের। সে কারণে বাংলাদেশের প্রতি বহিঃবিশ্বের ক্রেতাদের আগ্রহ অনেক বেশি। রপ্তানিতে একটি দেশ তখনি ভালো করে, যখন পণ্যের গুণগত মান ও মূল্য দুটোই ঠিক থাকে।

শেয়ার বিজ: চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা কী হতে পারে?

নাজমুল করিম: বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংকটে সিরামিক খাত। এ খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ছাড়া উৎপাদন অসম্ভব। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে এরই মধ্যে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ, গ্যাস না থাকায় পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। অনেক পণ্য নষ্ট হচ্ছে। কারণ নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ছাড়া পণ্য উৎপাদন করা যায় না। আর নির্দিষ্ট তাপমাত্রার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ থাকতে হয়। লোডশেডিং ও গ্যাস না থাকায় কোম্পানিগুলো এখন উৎপাদন করতে গিয়ে লোকসানে পড়ছে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সরকারকে আরও বেশি কৌশলী হতে হবে। খাতভিত্তিকভাবে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। সার্বক্ষণিক গ্যাস-বিদ্যুৎ ছাড়া কোনোভাবেই এ খাতের উৎপাদন পরিচালনা করা যায় না। এ শিল্পের যন্ত্রপাতিগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতেই থাকে। একটি মেশিন একবার বন্ধ হলে পরবর্তীতে এটি চালু করতে নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি মেশিন পুরোপুরি নষ্টও হতে পারে। সিরামিক কারখানাগুলোয় দিনে একাধিকবার লোডশেডিং হলে কেউই উৎপাদনে যেতে পারবে না। তাই খাতভিক্তিক গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেমন আমাকে যদি এক মাসের মধ্যে ১৫ দিন বিদ্যুৎ সংযোগ না দেয়, বাকি ১৫ দিনের একটানা বিদ্যুৎ দিতে হবে। তখন ব্যবসায়ীরা ১৫ দিনের প্রস্তুতি নিয়েই উৎপাদনে যাবেন। কিন্তু এভাবে যাওয়া-আসার বিদ্যুৎ দিয়ে এ খাত চলতে পারবে না।   

শেয়ার বিজ: সিরামিক খাতে সরকার কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?

নাজমুল করিম: আমাদের দেশে সিরামিক খাত নিয়ে সত্যিকারে গবেষণা নেই, নেই যথাযথ শিক্ষা। এ খাতের বড় পদগুলোয় বিদেশিরা কাজ করছেন। একদিকে আমাদের এ খাতের ওপর শিক্ষার অভাব, অন্যদিকে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। একজন বিদেশি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের বেতন মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার। সেখানে আমাদের একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের বেতন ২ হাজার ডলারও হয় না। এর কারণ শিক্ষা ও পেশাদারিত্বের অভাব। আমাদের সম্ভাবনা বিপুল, কিন্তু বড় জায়গাগুলোতে দক্ষ শ্রমিকের সংকট রয়েছে। সিরামিক বিষয়ে কোর্স চালু করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও অনেক পিছিয়ে। আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার মানোন্নয়ন দরকার। কেবল সনদ পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করলে হবে না। আমাদের দেশে শ্রমিক থাকলেও বড় জায়গাগুলোতে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা এখনও অনেক কম। অনেক কারখানায় এখনও বাইরের দেশের শ্রমিকরা কাজ করছে। বিপরীতে অনেক টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। শিল্প খাতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা গেলে ভবিষ্যতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। একটা জায়গায় স্বল্পতা আছে তা হচ্ছে, সেটা হলো সিরামিকের কাঁচামাল। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের কিছু মাটি ও বালি সিরামিকের জন্য খুবই উপযোগী। সুতরাং এখানে গবেষণার জায়গাটাও অনেক বাড়াতে হবে। গবেষণা খাতে সরকার নজর দিলে দেশেই অনেক কাঁচামাল তৈরি হবে। সিরামিক খাতের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া, শ্রমিকসহ সব কিছুই বেশ অনুকূল।

শেয়ার বিজ: সিরামিকের আন্তজার্তিক বাজার কেমন? আমরা কতটুকু ধরতে পেরেছি?

নাজমুল করিম: আমাদের উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এক সময় চীন, জাপান, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ উৎপাদনে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। এসব দেশে মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে। জাপানে টাইলস, টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন হাইটেক পণ্য উৎপাদনে ঢুকে গেছে। এখন তারা আর কাপ-প্লেট বানায় না। মানুষের যখন জীবনযাত্রা উন্নত হয়, তখন তারা বেশি পরিশ্রমের কাজে যেতে চায় না। আর সিরামিক ভারী শিল্প হওয়ায় অনেক দেশে এখন উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে সুযোগ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। এ সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০