Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 9:29 pm

দেশ কি নৈতিকতার মহামারিতে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে!

মোহাম্মদ আবু নোমান: একজন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি, একটি দেশের সেনা-নৌ-বিমান-পুলিশবাহিনী প্রধান, সচিব, শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রধান প্রকৌশলী, রাষ্ট্রীয় সংস্থার এমডি, একজন ভিসি; এরপরও কোনো মানুষের আর কী চাওয়ার থাকতে পারেÑএকজন মানুষকে কোনো দেশের আর কী দেয়ার থাকতে পারে? এসব পদে যারা থাকেন তাদের অর্থ, সম্পদ, সম্মান, ক্ষমতা, কী না থাকে? একজন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান চাকরিকালীন কীভাবে সহস্র বিঘা জমি ও হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন? এটা শুধু তাদের দ্বারাই সম্ভব যাদের ‘উপরি’ ইনকাম বেতনের ৫০০ থেকে ১০০০ গুণ বেশি। একদিকে ভূমিহীন, ক্ষুধা, তৃষ্ণা! অন্যদিকে (বেনজীরের) ৬৯৭ বিঘা জমি, রিসোর্ট, ঢাকায় ১২টি ফ্ল্যাট, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, একটি বেসরকারি টেলিভিশনসহ দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এবং ৩টি বিও হিসাব, যা মাত্র (পাবলিস আউট) প্রকাশিত। এছাড়া অনুদ্ঘাটিত, অপ্রকাশিত, অপ্রচারিত যাকে বলে আনপাবলিস, ফাঁস হয়নি, হবেও না, এমন সম্পদ প্রকাশিতের চেয়ে কতগুণ বেশি এটা কল্পনাও করা যাবে কী?

এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই; কারণ স্বাস্থ্যের ডিজির ড্রাইভার, পুলিশের এসআই, কাস্টমসের পরিচালক, ওয়াসার পিয়ন, তিতাসের ক্লার্ক, বিদ্যুতের কর্মচারী, খাদ্যের গুদাম রক্ষক, সচিবালয়ের অফিস সহকারী, আরও কত হ্যান-ত্যান, তারপর আরও আছে দালাল-ফালাল, ভেল্কি, এরা যদি অর্থের পিরামিড গড়তে পারে, ঊর্ধ্বতনদের কী অবস্থা তা আমজনতার বুঝতে বাকি থাকে না। এরা একা খায় না, আশপাশের মুখ বন্ধ করতে ভাগাভাগি করেই খায়।

বেনজীর আহমেদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তখনকার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বলেছিলেন, তুলনা করা ঠিক নয়, তবুও বলছি “দেশ যেমন জাতির জনক ‘বঙ্গবন্ধুর’ অভাব অনুভব করে, তেমনি পুলিশ বাহিনী ‘বেনজীর আহমেদের’ অভাব অনুভব করবে। আসলে বেনজীরের অভাব-অনুভবের কোনো কারণ নেই। কারণ ইতোমধ্যে নতুন করে বিপুল সম্পদ অর্জন নিয়ে ফের আলোচনায় এসেছেন, বেনজীরের অ্যাটেন্ডিং অনুচর, অনুবর্তী, ডিমএপি সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। আসলে এসব দেখে স্পষ্ট হচ্ছেÑ আমাদের গাছের গোড়াতেই পচন…!”

একটি দেশের বিভিন্ন সেক্টরের সর্বোচ্চ পদে থেকেও কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা হারিয়ে যদি ‘উপরি ইনকামের’ পথ খুঁজেন, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বস্তরে অর্থ-বৈভব অর্জনের প্রতিযোগিতা থাকবেই। যার উদাহরণ দেশে একজন ড্রাইভার থেকে তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর থাকছে অনেক দামি ফ্ল্যাট, বিঘায়-বিঘায় জমি, গাড়ি ও বিদেশে বাড়ি। ওরা আবার সবাই স্ত্রীদের চেয়ে ‘গরিব’ অভাবী হিসেবে থেকেই সরকারি কর্মচারী পরিচয়ে জনসেবা ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেশসেবায় লাইফটাইম শেষ করছেন! এ অর্থ ক্ষুধার্থদের কে থামাতে পারবে? ওদের কাছে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠছে পৃথিবীর ‘অর্থরাজ্য’। এদের নিয়ে কীভাবে দেশটা ২০৪১ সালে অর্জন করবে উন্নত, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা? ভাবলে অবাক লাগে! দোষ কি শুধু অপরাধীর? জিরো টলারেন্সের দেশে দুর্নীতি এত সর্বগ্রাসী হয় কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ বক্তব্যকে একটা সস্তা বক্তব্যে পরিণত করেছে সরকার।

বেনজীরের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট হলে তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, “দুয়েকজন অনেক ক্ষিপ্ত, খুবই উত্তেজিত হয়ে এক্ষুনি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, লিখে ফেলছেন। দয়া করে সামান্য ধৈর্য ধরুন। ঘোষণাই তো আছে ‘কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’। মানে বেনজীর নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন কিসসা বা খেলা বাকি আছে। তো বেনজীর খেলেছেন! অনেক খেলেছেন। ব্যাংক (মাত্র ৩৩টা) থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। কেন পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশনরে ঘুম ভাঙে? দেশে ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। অথচ ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ যখন বিমানবন্দর দিয়ে পার হচ্ছে, কিংবা ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে, কেন আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কাজ করে না?”

ধারণা করাই যায়, ‘কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’! বেনজীরের হাতে তুরুপের তাস নিশ্চয়ই কিছু আছে! স্মার্ট আর ধূর্ত, দুটো শব্দই তার বেলায় প্রযোজ্য। যারা তাকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করেছে, তাদের অপকর্মের প্রমাণও নিশ্চয়ই বেনজীর নিরাপদে কোথাও রেখে দিয়েছেন। যখন বেনজীর বুঝতে পারবেন সে ডুবেই যাচ্ছে, তখন শুধু একা নয় সঙ্গে অন্যদেরও ডোবানোর ব্যবস্থা করবেন। তাই অনাকাক্সিক্ষত অনেক কিছুই ঘটতে পারে আগামীতে।

দেশের খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, প্রবাসী মানুষগুলো নিজেদের উজাড় করে কী ভয়াবহ পরিশ্রমই না করছেন! বিনিময়ে দেশ কী দিচ্ছে কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসীদের? তারা কি আরেকটু সুশাসনের আশা করতে পারেন না! যা চলছে, তা-ই কি তাদের প্রাপ্য ছিল! কে দেখাবে একটু আলো, কে শোনাবে একটু আশার বাণী? এ-ই কি তাদের ভাগ্যলিপি! এমন হওয়ার কথা ছিল কী? সরকার শুধু তাদের প্রতিশ্রুত দুর্নীতি, চুরি, লুট, পাচার বন্ধ করুক। আমাদের একমাত্র আশার জায়গা, ভরসার জায়গা দেশ-বিদেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলো দেশকে সোনার দেশ বানাবে। ঘুমিয়ে থাকা প্রশাসন, রাষ্ট্র, বিবেক, কবে জাগবে? দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেটদের পেট থেকে দেশটাকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব কে নেবে?

দেশের কিছু মানুষের পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ‘সম্পদ’। প্রতিটি দপ্তর, উপ-দপ্তর, কী সরকারি কর্মকর্তা, কী নেতা, মন্ত্রী, এমপি, কী ছাত্রনেতা; যে যেভাবে পারছে দেশটাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে, খুবলে-চুষে খাচ্ছে। মানুষ ধরা-মারা থেকে আসছে টাকা, চোর ধরা-ছাড়ার মধ্যে থাকছে লেনদেন, নিয়োগ-বদলিতে বাণিজ্য, রাস্তাঘাটের দরপত্র থেকে শুরু করে সিন্ডিকেটে দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত।

এর আগে আমরা দেখেছি, পিরোজপুরের নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান জমির নামজারি করার জন্য তার সহকর্মীদের ৬ হাজার টাকা ঘুষ নেবে বলে ‘ঘুষ নির্ধারণ’ করে দিয়েছিলেন। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় কথোপকথনের একটি অডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নে এক সেবাগ্রহীতা বলছেন, ‘সব খারিজ তো সমান না। গরিব মানুষ, কাজটা করে দিয়ে দেন।’ উত্তরে ভূমি কার্যালয়ের সহকারী আবদুল কাদির বলেন, ‘কথা ছিল ৬ হাজার টাকা দিবেন। কম দিতে পারবেন না। প্রয়োজনে পরে হলেও দিতে হবে। একটা কাজ করে কিছু টাকা পাওয়া না গেলে চলে?’ এরপর ঘুষের টাকাগুলো গুনে গুনে পকেটে ভরেন আবদুল কাদির।

একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকের রাষ্ট্রের সেবা পাওয়ার অধিকার আজ কতটা মুমূর্ষ উক্ত ঘটনা দুটোই তার প্রমাণ। ভূমি অফিসে এমন আবদুল কাদির শতকরা ৯৮ ভাগ। কতজনকে সংশোধন করবেন? এই চিত্র প্রতিটি ভূমি অফিসের, বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর কোনো শক্তিই এদের দুর্নীতি ও হয়রানি রোধ করতে পারবে কী? ভূমি অফিসের কয়জন কাদির ঘুষ খায় না? দেশটা তো আসলে কাদের ও মাসুদ মিয়াদের। আমরা তো হলাম তাদের ক্রীতদাস, যা চাবে গুনে গুনে তাই দিতে হবে, যা বলে তাই করতে হবে। এই কাদের মিয়াদের কিছু হবে না। কারণ এ টাকা সে একা খায় না। উপরওয়ালাদের ম্যানেজ করেই খায়।

ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া কিংবা ঘুষ ছাড়া সেবা না পাওয়া থেকে প্রমাণিত হয়, ঘুষ আদায় এখন প্রাতিষ্ঠানিকতার রূপ নিয়েছে। কিন্তু এ ঘুষ-দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে কীভাবে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলেছিল। কিন্তু গত প্রায় ১৬ বছরের শাসনে খুব কম ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন দেখা গেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে।

এমন একটা দেশ যেখানে মাইকিং করে, সবাইকে অবগত করে, ঘোষণা দিয়ে, তারিখ ঠিক করে, চোরকে হাজির হতে বলা হয়। ওদিকে ততক্ষণে চোর অর্থকরি নিয়ে পগার পার। এটাও একটা দেশ…, পুরাই সার্কাস! দুর্নীতি দমন কমিশনের জনৈক আইনজীবী গত ১৩ জুন বলেছেন, ‘আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন দুদক কমিশন যদি মনে করে, তাহলে মামলা হবে।’ এটা দুদকের অনেক বড় আবিষ্কার! দুদক পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখে। কি মজা প্রমাণ পাওয়া গেছে! গণ্ডারকে নাকি আজকে সুরসুরি দিলে সে একমাস পর বুঝতে পারে, তাকে কেউ সুরসুরি দিয়েছে। যা-ই হোক, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, আরও কত কিছু পাওয়া যাবে, শুধু বেনজীর স্যারকে আর পাওয়া যাবে না, এ-ই আর কি!

২০২০ সালের ২৫ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীর আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারে শেষ প্রশ্ন ছিল, যখন অবসরে যাবেন, পুলিশকে কোন জায়গায় দেখতে চান? জবাবে বেনজীর বলেছিলেন, ‘অবসরে গেলে কেমন পুলিশ দেখতে চাই, গত ৩২ বছর নিজে সেই পুলিশ হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার সহকর্মীদের সেই পথে মোটিভেট (উৎসাহিত) করেছি।’ বেনজীরের মোটিভেশনের রেজাল্ট আমরা দেখেছি কোটিপতি ইন্সপেক্টর সোহেল রানা, সিরিয়াল কিলার প্রদীপ ছাড়াও বর্তমানে নতুন করে বাজার গরম করা খবর ডিমএপি সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ সম্পদ অর্জন দেখে। আমরা বলতে চাই, বেনজীর আহমেদের ‘মোটিভেশনে’ পুলিশের আরও কারা কারা উৎসাহিত হয়েছে, দেশত্যাগের আগে দুদক কি সেই খোঁজ নেবে? 

সাংবাদিক