দেয়ালঘেরা নগরী

স্পেনের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী মাদ্রিদ। মাদ্রিদের পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক একটি শহর। রাজধানী থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে এ শহরটি। নাম আভিলা। এ শহরের পুরোনো যে অংশটা রয়েছে, তার পুরোটা একটা বিশাল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এ কারণে একে বলা হয়ে থাকে দেয়ালঘেরা নগরী। এ দেয়ালটা একসময় আভিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। এখন এটি মূলত আভিলার খ্যাতির প্রধান কারণ। এজন্য শত শত ভ্রমণপিয়াসিরা শহরটি দেখার জন্য ভিড় করেন।
আভিলা শহরটা এক পাথুরে উপত্যকায় অবস্থিত। চারপাশে গাছপালা তেমন নেই, বরং পাথুরে প্রকৃতি বলা যায়। চারপাশটা পাহাড়-পর্বতে ঘেরা বলে শহরটা নিতান্ত অরক্ষিতও ছিল না। তবু এ নিরাপত্তার জন্যই পুরো শহরকে ঘিরে বানানো হয় এ পাথুরে দেয়াল। প্রায় আড়াই হাজার মিটার লম্বা এ দেয়াল আক্ষরিক অর্থেই শহরটিকে চারপাশ দিয়ে বেষ্টন করে রেখেছে। একটুও ফাঁকা রাখা হয়নি। অবশ্য এর ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে।
শহরটির পত্তন হয় যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ও ৫০০ বছর আগে। তখন শহরটি ভেটনদের অধিকারে ছিল। পরে আভিলা রোমানদের অধীনে আসে। তখন শহরটি হিস্পানিক বা স্প্যানিশ লুসিতানিয়ার অন্তর্গত ছিল। প্রাচীন রোমের আবুলা, আবিলা, আবেলা, আবলা প্রভৃতি নামের যেসব শহরের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল, ধারণা করা হয় সবকটিই আসলে এ আভিলা। ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা এ শহরটির দখল নেয়। পরে আরবের মুসলিম শাসকদের অধীনে থাকে প্রায় ৩৫০ বছর। উত্তরের আইবেরিয়ান-খ্রিষ্টান রাজ্যগুলো আভিলা দখলে চেষ্টায় ত্রুটি করেনি, কিন্তু তাদের কোনো আক্রমণই ফলপ্রসূ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই অসাধ্য সাধন করেন ক্যাস্টিল অ্যান্ড লিওনের রাজা আলফনসো।
অনেক সাধনায় পাওয়া এ আভিলা আরেক দফা হাতছাড়া হওয়ার কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না রাজা। তাই দখল করার পরপরই তার বোন-জামাই রেমন্ডকে দায়িত্ব দেন শহরটিকে সুরক্ষিত করে গড়ে তুলতে। বার্গান্ডির যুবরাজ রেমন্ড নিজেও কম বিখ্যাত নন। তিনি বিদেশ থেকে দুজন কারিগরকে ডেকে আনেন। তারা হলেন কাসান্দ্রো রোমানো ও ফ্লোরিন দ্য পিতুয়েঙ্গা। শহরের চারপাশ ঘিরে শক্তিশালী পাথুরে দেয়াল তোলার নির্দেশ দেন তাদের। দুই কারিগর এক দশকের মধ্যেই পুরো আভিলাকে আয়তাকার দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলেন।
আভিলার চারপাশ দিয়ে আড়াই হাজার মিটারের এ দেয়াল শহরটিকে রীতিমতো দুর্গ বানিয়ে তুলেছে। ১২ ফুট উঁচু দেয়ালটির পুরুত্ব প্রায় ১০ ফুট। দুর্গের প্রাচীরে যেমন চলাচলের পথ থাকে, ঠিক তেমনই দেয়ালের ওপরেও পথ রয়েছে। আছে ৮৮টা প্রতিরক্ষা টাওয়ার। আয়তাকার দেয়ালের বিভিন্ন দিকে ৯টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এ প্রবেশদ্বার ছাড়া শহরে প্রবেশ করার অন্য কোনো পথ নেই, পুরো শহরটাই যে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত এ টাওয়ারগুলো দেয়ালটাকে সত্যিই একটা দুর্গ-প্রাচীরের চেহারা দিয়েছে।
শহরের দেয়ালঘেরা অংশটা এখন পুরোনো আভিলা বা ওল্ডটাউন হিসেবে পরিচিত। আর স্বাভাবিকভাবেই শহরের সব ঐতিহাসিক স্থাপনাও এ দেয়ালঘেরা পুরোনো আভিলায় অবস্থিত। সেসব স্থাপনার মধ্যে আছে গথিক রীতিতে বানানো পুরোনো ক্যাথিড্রাল, সেন্ট থমাসের গির্জা, থমাস দ্য তরকেমাদার সমাধি ও ডন জুয়ানের সমাধি। তাদের মধ্যে থমাস দ্য তরকেমাদা ছিলেন সমগ্র স্পেনের প্রথম ও প্রধান বিচারক। আর ডন জুয়ান ছিলেন স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার একমাত্র সন্তান। আরও আছে রোমান রীতিতে বানানো অনেক চার্চ।
আভিলার সেই ঐতিহাসিক দেয়াল অটুট আছে এখনও। দেয়ালের অর্ধেকটার ওপরের পথে এখনও ঘুরে বেড়ানো যায়। এখন আবার পুরো দেয়ালজুড়েই হলদে-কমলা হ্যালোজেন বাতি লাগিয়ে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। রাত হলেই পুরো দেয়ালে হলদে-কমলা রঙের আলো জ্বলে ওঠে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেয়াল এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বড় আলোকিত স্থাপনা। ১৯৮৫ সালে শুধু এ দেয়ালটাকেই নয়, বরং দেয়ালসহ পুরো আভিলাকেই ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০