দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ দরকার

প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল : দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম আকাশছোঁয়া। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই কিছুদিন পরপর সব জিনিসের দামের এমন ঊর্ধ্বগতি প্রায়ই দেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে অনাকাক্সিক্ষতভাবে মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার খবর চোখে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও সবকিছু আগের জায়গায় চলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কারণ ছাড়াই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায় এবং সেটা একরকম স্থায়ী রূপেই রয়ে যায়। বিশেষ করে পূজা, রমজান বা অন্যান্য বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় এলেই যেন আরও লাগামহীনভাবে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, যা নি¤œ-আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।

বাজারে পণ্যের দাম কেন বাড়ে? সাধারণত চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে বাজারে যেকোনো জিনিসের দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুক্তবাজারে যখন যেকোনো পণ্য সহজেই আমদানি করা যায়, তখন দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতা নেই বললেই চলে। সুযোগ পেলেই কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সভ্য দুনিয়ায় খুচরা পর্যায়ের বাজারেও কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। দুর্ভাগ্য, আমাদের তা নেই। ফলে বাজার যখন-তখন চরমভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ এখন দৈনন্দিন বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রীতিমতো প্রমাদ গুনছে। সবচেয়ে বিপদে আছে নি¤œ আয়ের মানুষ।

একদিকে আয় কমে যাওয়া আরেক দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে কষ্টে দিন যাচ্ছে স্বল্প ও নিন্ম আয়ের মানুষের। সামনে রমজান, তার আগেই নিত্যপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি উদ্বিগ্ন করছে সবাইকে।

বাজার পরিস্থিতির উচ্চমূল্যের কারণে এক বছর ধরে দেশের দরিদ্র, নি¤œ আয়ের মানুষ এমনকি মধ্যবিত্তরা আছে অসহায় অবস্থায়। এরই মধ্যে আসন্ন রমজান ও ঈদুল ফিতর ঘিরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা বেড়ে গেছে। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের স্বভাব হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেই অন্য পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নজরদারি না থাকায় নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিস্থিতি যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আগামী রমজান ও ঈদুল ফিতরে এই বাজার সংকট দেশের বড় অংশের মানুষের জন্য আরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তার প্রমাণ মেলে টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন দেখে। এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে, শহরের চাকরিজীবী পরিবারের গৃহিণী ও অন্যান্য সদস্যকে ট্রাকে লাইন দিতে। অর্থনীতির হিসাবে গড় আয় এবং প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের আয় বাড়েনি, ক্রয়ক্ষমতা বরং হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বাড়তি, টাকার মান কমছে, ফলে মানুষের প্রকৃত আয়ও কমতির দিকে। এ অবস্থায় কেবল পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষ। করোনাকালে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে এবং এখন তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সরকার হতদরিদ্র মানুষদের জন্য ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি করে, যাতে তারা কম মূল্যে পণ্যদ্রব্য কেনার সুযোগ পায়। কিন্তু কিছু মধ্যবিত্ত মানুষ আছে এই সুযোগ কাজে লাগায়, তারা কম দামে পণ্য কিনে বেশি দাম পাওয়ায় বাইরে বিক্রি করে দেয়।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারির ভেতরেও কিছু মানুষের ধনী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে মানুষের ভোগবিলাসতা ও দেশ-বিদেশে ভ্রমণ বন্ধ থাকা, যার কারণে কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে এসব মানুষের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। যেখানে কোটি টাকার বিষয় জড়িত, সেখানে তাদের কাছে দু-একশ টাকা কোনো বিষয়ই নয়। কিন্তু দেশে যে পাঁচ কোটির বেশি দরিদ্র মানুষ আছে, তাদের কাছে এই দু-একশ টাকার বিষয়টি অনেক উদ্বেগের। সেইসঙ্গে দেশের অন্যান্য সব পেশাজীবীর জন্য অনেক বড় উদ্বেগের বিষয়। কেননা প্রতিমাসে নির্ধারিত আয়ের সঙ্গে যদি বাড়তি ব্যয় একের পর এক যোগ হতে থাকে, তাহলে তাদের মাস চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আর দিনমজুর বা খেঁটে খাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে তো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

এতকিছুর মধ্যে আশার কথা হচ্ছে, সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের ওপর শুল্কারোপ না করার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দল আর দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ না পায়। শুধু শুল্কারোপ রোধ করে থাকলেই হবে না, অবৈধভাবে কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেন দাম বাড়াতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে দেশের মানুষ দিনের পর দিন সরকারের প্রতি বিরাগী ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে ঘুষ, কালোবাজারি ও দুর্নীতি। সমাজের ভেতরে মানুষে মানুষে বাড়বে হানাহানি। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের ভেতরে অসৎ উপায়ে ও স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা অধিকহারে দেখা যাচ্ছে। আর এই ধনী হওয়ার খেলায় মেতেছে অনেকেই, যার ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে নানা অসংগতি। বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী-গরিবের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ফারাকের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেন কোনো সিন্ডিকেট মহল আর বাড়াতে না পারে, সেদিকে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা কলেজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০