Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 1:24 am

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শেষ কোথায়!

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম একটা বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে, একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কখনোই কমে না। এতই বেড়ে যাচ্ছে যে, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে-অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। কখনও রোজা, কখনও ঈদ বা কখনও জাতীয় বাজেট ঘোষণার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা এক নিয়মিত ঘটনায় রূপ নিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সেই কভিড সংক্রমণের শুরু থেকে যে দ্রব্যসামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে, দাম কমানোর কোনো নাম নেই।

বাংলাদেশে অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে গিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে জনসাধারণ। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাটছাঁট করতে একরকম বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ। কোনো কোনো পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুণ বেড়েছে। গত কয়েক মাস ধরে এসব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। চাল, ডাল, ডিম, চিনি ও তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। সাধ্যের বাইরে মুরগি, গরু ও খাসির গোশত। বলা হতো, ডাল-ভাত-আলু ভর্তা হলো গরিবের খাবার। যার অবস্থা কিছুটা ভালো, তার পাতে জুটত বড়জোর ডিম, ব্রয়লার মুরগি অথবা পাঙাশ মাছ। এখন এর কোনোটিই গরিব বা নি¤œআয়ের মানুষের নাগালে নেই। সবশেষ বাজার পরিস্থিতি বলছে, মোটা চালের কেজি ৫৫-৫৬ টাকা, মসুরের ডাল ১৩৫ টাকা; বাজারে সর্বোচ্চ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা কেজি দরে। পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ১৯০ থেকে ২২০ টাকায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন হলো, গরিব ও নি¤œআয়ের মানুষ খাবে কী? কেন বাজারের এ অবস্থা? নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সকল প্রকার সামগ্রীর মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। এমন কোনো আইটেম নেই, যার দাম কমেছে বলে শোনা যায়। ৫০ টাকায় কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। একজন দিনমজুর কীভাবে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে? খেটে খাওয়া শ্রমজীবী অসহায় সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত আয়-রোজগারের সঙ্গে এই মূল্যবৃদ্ধির কোনো সামঞ্জস্য নেই। এদিকে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি পেলেও মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাজার অবস্থা বর্তমানে এমনই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বাজার ব্যবস্থার যে একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন থাকে, তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম। একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাই এখন বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই দামে মানুষ একটু অভ্যস্ত হতে না হতেই আবারও দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থা দেশের সীমিত আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে কীভাবে শোচনীয় অবস্থা ডেকে আনছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সব মিলে সমাজের ৪০ শতাংশ মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই মুখ্য। দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা ঝুঁকি, সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। পত্র-পত্রিকা ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের নানা মন্তব্য থেকে বলা যায়, দেশ ভয়াবহ পাঁচটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি অন্যতম একটি।

দ্রব্যমূল্য লাগামহীন অবস্থা চলতে থাকলে মানুষের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকবে না।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমাতে কৃষি একটা বড় ভ‚মিকা পালন করবে। সময় এসেছে কৃষিতে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে উৎপাদন বাড়ানোর। আমাদের পলি মাটির এই দেশে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জোগান আমরা নিজেরাই দিতে পারি। কিন্তু এর জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা।

পণ্যমূল্য সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। যার ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ও ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর পথ সহজ হবে। মানুষকে মূল্যস্ফীতির চরম ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে হলে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে রক্ষণশীল হতেই হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্টোরেজ করে সংরক্ষণ করতে হবে। টিসিবিকে ব্যবহার করে বা বাজার মনিটরিং জোরদার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি সমাধান নয়। দ্রব্যমূল্যকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে বজায় রাখার জন্য একটি স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে। এ জন্য কৃষির উৎপাদন আধুনিকীকরণ করা ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত। বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এই ভর্তুকির সঠিক ব্যবস্থাপনা সচ্ছতার সঙ্গে মনিটরিং করাও জরুরি।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনগণের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে জোরদার করা একান্ত প্রয়োজন। সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

কণিকা রানী

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়