দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক

আবু জাফর সিদ্দিকী: দিন দিন দেশে প্রয়োজনীয় দ্রব্য, তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার এবং সবশেষে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সবই জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। গত জুন মাসে শ্রীলঙ্কায় খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশটিতে বর্তমানে চরম খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে ৬৩ লাখ মানুষ। হঠাৎ অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে, যা শতকরা ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পেট্রোল ৫১ শতাংশ বেড়ে ১৩০ টাকা লিটার হয়েছে। তেমনই ডিজেল ও কেরোসিনের ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি হয়ে ১১৪ টাকা লিটার হয়েছে, যার পূর্বমূল্য ছিল ৮০ টাকা লিটার। সম্প্রতি ইউরিয়া সারের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা করে বেড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, চাল, ডাল, মাংস সবকিছুর দামই আকাশছোঁয়া। তাহলে দেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে?

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকারি তেল ও গ্যাস কোম্পানি সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (সিপিসি) বলেছে, গণপরিবহনে ব্যাপক ব্যবহƒত জ্বালানি ডিজেলের দাম ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৪৬০ শ্রীলঙ্কান রুপি (১.২৭ ডলার) করা হয়েছে। আর পেট্রোলের দাম ২২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৫০ রুপি (১.৫১ ডলার) করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় এক কেজি চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে এক হাজার ১০৬ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩৩০ টাকা। চিনির কেজির দামও একই। ৪০০ গ্রামের এক প্যাকেট গুঁড়া দুধের দাম তিন হাজার শ্রীলঙ্কান রুপি বা প্রায় ৯০০ টাকা। এক কাপ চা ৩৮০ রুপি বা প্রায় ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাল রপ্তানিকারক শ্রীলঙ্কা বর্তমানে এটি আমদানি করছে এবং চালের দাম সে দেশে এখন ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে বর্তমানে বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৩০ রুপি কেজি দরে। এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। প্রতি লিটার নারিকেল তেল বিক্রি হচ্ছে ৭৪১ রুপিতে, যা আগে ছিল ৩২০ রুপি। দু’বছরে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১৩২ শতাংশ। এছাড়া বাজারে সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৪০ রুপিতে, যার পূর্বমূল্য ছিল ১০০ রুপি। দু’বছরে চিনির মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ২৪০ শতাংশ।

শ্রীলঙ্কায় চোখ কপালে ওঠার মতো দাম কাঁচামরিচের। দেশটিতে বাজারে গিয়ে এক কেজি কাঁচামরিচ কিনতে হলে গুনতে হবে ৯০০ রুপি। ২০১৯ সালে নভেম্বরে এই কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে ৩২০ রুপিতে। এ কয়েক বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৮১ শতাংশ। একই দশা ডালের বাজারে। দেশটিতে এক কেজি ডালের দাম ৬২০ রুপি। আগে ১২০ রুপিতে এক কেজি ডাল কিনতে পারলেও সেসব এখন সোনালি অতীত। এক ডালেই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৪১৭ শতাংশ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ধুঁকছে শ্রীলঙ্কা। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা মানুষ। কাগজের সংকটে বন্ধ হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রকাশনা, বাতিল হয়েছে স্কুলের পরীক্ষা। ভয়াবহ মন্দায় প্রাণ বাঁচাতে সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের তালিম নাড়ুতে আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে। ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর এত বড় অর্থনৈতিক সংকট দেখেনি শ্রীলঙ্কা। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছানোয় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির সরকার। শ্রীলঙ্কাজুড়ে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপর্যস্ত জনজীবন। জ্বালানির তীব্র সংকট আরও খারাপ করেছে পরিস্থিতি। চলতি বছরের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা দেশটির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। মে মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও দেশটিতে ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ২২০ দশমিক ২০ শতাংশ, যা অকল্পনীয়।

শ্রীলঙ্কার পথে কি হাঁটছে দেশÑএমন প্রশ্ন এখন সবার। কারণ দেশে মাছ, মাংস, তেল, চাল, সবজি, গ্যাস, বিদ্যুৎÑকোনটার দাম বাড়তি নয়? অর্থাৎ সবকিছুর দামে ঊর্ধ্বগতি। মানুষের আয় বাড়লেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। প্রায় দেড় থেকে দুই যুগ আগে যখন এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৬০ টাকা ছিল, তখন একজন দিনমজুর ৬০ টাকা দিনে কাজ করত। বর্তমানে গরুর মাংস ৬৫০-৭০০ টাকা কেজি, কিন্তু একজন দিনমজুরের দিনে আয় ৪০০ টাকা। তাহলে মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত, শ্রমিক ও মজুর শ্রেণির মানুষের কীভাবে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব? মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান বা কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংস খাওয়া যেন এক অসাধ্য বিষয়। তার ওপর বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল/সিলিন্ডার খরচ, গাড়িভাড়া, পত্রিকা বিল, সন্তানের লেখাপড়া খরচ, চিকিৎসা খরচসহ জীবনযাপনে খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। এরই মধ্যে হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে, যা নতুন করে দেশের মানুষকে চিন্তায় ফেলেছে। এক কেজি শাক ৩০ টাকা, কচুর লতি ৪০ টাকা কেজি, লাউ প্রতিটি ৪০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০ টাকা কেজি, ঢেঁড়স ৬০ টাকা কেজি, শজনে ৬০ টাকা কেজি, তরমুজ ৬০ টাকা কেজি, আপেল ৩০০ টাকা, বেদেনা ৪০০ টাকা কেজি, একটি ডাবের দাম ১২০-১৬০ টাকা, কলা প্রকারভেদে ৩০-৪০ টাকা হালি, যা কিনতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে মধ্যবিত্তদের। টেংরা মাছ, শিং মাছ, বাইম মাছ ৫০০-৬০০ টাকা কেজি। আগে যেখানে ২০ হাজার টাকা বেতনের একজন চাকরিজীবী টেনেটুনে পুরো মাস সংসার চালাতে পারতেন, এখন সেই টাকায় মাসের অর্ধেক পার করা কঠিন হয়ে উঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক কলহ বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে কয়েক গুণ পর্যন্ত হয়েছে। প্রতিটি পণ্যদ্রব্য কিনতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। টিসিবির পণ্য কিনতে দিনভর অপেক্ষা এবং গাড়ির পেছনে দৌড়ানো দেখে বোঝা যায় মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কেমন করে দিন পার করছে। দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্রের দৌরাত্ম্য। একজন কৃষক একটি লাউ চাষ করতে জমি তৈরি করে, বীজ বপণ করে, পরিচর্যা করে এবং অর্থ খরচ করে ৪৫ দিন পরে একটা লাউ পাইকারি বিক্রি করেন ২০ টাকায়। অথচ কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে দাম হয়ে যায় ৪০ টাকা। এই সংঘবদ্ধ চক্রের দৌরাত্ম্য রোধ করতে না পারলে দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একসময় বিভিন্ন কারণে বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু সেদিনের সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ আজ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ মানুষের ভেতরেই অসৎ উপায়ে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা বর্তমানে অধিক হারে দেখা যাচ্ছে। অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। আমাদের সবুজ-শ্যামলে ভরপুর নদীমাতৃক সোনার দেশ কোন পথে হাঁটছে, তার সঠিক জবাব কারও কাছেই নেই। তবে সেই কঠিন সময় পার করে সুসময় ফিরে পাক সোনার দেশ, বাংলাদেশ।

গণমাধ্যম কর্মী, নাটোর

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০