দ. এশিয়ার সমৃদ্ধির জন্য বাড়াতে হবে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী ও সফল অর্থনৈতিক জোট রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আঞ্চলিক বøক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায়ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বাড়ানোর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিভিন্ন জটিলতা নিরসনে বেসামরিক আলোচনার বিষয়ে জোর দিতে হবে। নীতিনির্ধারকদের আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। আর এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ বাড়াতে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

রাজধানীর বনানীতে একটি হোটেলে গতকাল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ১৪তম দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনে (এসএইএস ১৪) বক্তারা এ কথা বলেন। দুদিনব্যাপী এ সšে§লনের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ পার্লামেন্টের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, কভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হয়ে গেছে। আমাদের সেই পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমরাও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজ করছি। আমারা এরই মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পাশপাশি শিশু শিক্ষার হার বাড়িয়েছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চতুর্থ শিল্প গ্রহণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে আঞ্চলিক দেশগুলোর এক সঙ্গে কাজ করতে হবে তিনি মন্তব্য করেন।

এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে যে পরিমাণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়, তার মাত্র আট শতাংশ সংঘটিত হয় এসব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে। বাকিটা সম্পন্ন হয় দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাইরে। এ এলাকার সমৃদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যে পণ্যের আদান-প্রদান ও মানুষের চলাফেরা বাড়াতে হবে। তিনি উল্লেখ

করেন, ভারত বাংলাদেশকে অসংখ্য পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু নানা ধরনের অশুল্ক বাধার কারণে সেই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাণিজ্য সম্প্রসারণে এসব বাধাসহ আরও যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে আরোচনার তাগিদ দেন তিনি।

এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে আশাব্যঞ্জক হারে। বর্তমান সরকারের সহায়ক নীতি ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ভিরেসিঙ্গে বলেন, জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর ২৫ শতাংশ মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের অবদান সীমিত। আমাদের এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সংকটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশ যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেজন্য তাদের ধন্যবাদ। আমাদের এভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য।

সম্মেলনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান  রেহমান সোবহান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অবাধ আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার বিশাল সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য প্রবাহে পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণে সেই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো শুল্ক ও অশুল্ক বাধা বলে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, এসব বাধা দূর করে এক দেশ অন্য দেশে বিনিয়োগ এবং সীমান্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করতে পারলে ‘আসিয়ান’-এর মতো এ অঞ্চলও শক্তিশালী একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এক দেশের পরিবহন যাতে অবাধে অন্য দেশে যেতে পারে, এক দেশের শ্রমিক যাতে অন্য দেশে কাজ করার সুযোগ পায় এবং অবাধ সীমান্ত নিশ্চিত হয়, সেজন্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আসিয়ান বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলা যেতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, দেশগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে, সেগুলো বেসামরিক পর্যায়ে আলোচনার টেবিলে সমাধান হওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সক্রিয় নাগরিক সমাজের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। নাগরিক সমাজের এ ধরনের আলোচনায় সম্পৃক্ত হয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

একক মুদ্রায় বিনিময় জটিল প্রক্রিয়া: সম্মেলনে ‘ম্যাক্রোইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড দি পসিবিলিটি অব কমন কারেন্সি’ শীর্ষক সেমিনারে অর্থনীতিবিদরা বলেন, এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একক মুদ্রায় বিনিময় করা হবে একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। সে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করে মুদ্রা বিনিময় হবে জটিল প্রক্রিয়া। তাছাড়া রয়েছে আন্তঃসীমান্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একক মুদ্রা বিনিময় হারে রয়েছে একাধিক বাধা এবং এই প্রক্রিয়া হবে অনেক জটিল। সুতরাং আমি এই মুহূর্তে এই প্রক্রিয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। একই মত দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মধ্যে একক মুদ্রায় বিনিময়ে কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। একক মুদ্রায় বিনিময়ের আগে নানা ধরনের কাজ করতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলো একক মুদ্রায় বিনিময় করতে পারছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের একক ভিসা রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী দেশের ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। সেটা থাকলে তা সম্ভব হবে না।

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন আমরা কী করতে পারি, তা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে সর্বাগ্রে উদ্যোগ নিতে হবে বাণিজ্য সহজীকরণে। এক্ষেত্রে ভারতকে সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখতে হবে। বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে, ভিসা ইস্যু, সীমান্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হবে।

দক্ষিণ এশীয় আন্তঃবাণিজ্য বাড়াতে সিডিপির তিন পরামর্শ: সম্মেলনের প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কিছু পদক্ষেপ নিলে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বিস্তৃত করা সম্ভব। তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নতুন নতুন সুযোগ খুঁজে বের করা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে কাজগুলো করা ও কাঠামোভিত্তিক কাজের মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার ভুলগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাড়াতে শক্তিশালী আঞ্চলিক সংযোগ, সহযোগিতা এবং বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ করার ওপর জোর দিতে হবে। তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সঠিক অবকাঠামো উন্নয়ন, দেশগুলোর একে অন্যের প্রতি আস্থাহীনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার কারণে এই অঞ্চলে খুব বেশি আঞ্চলিক বাণিজ্য বিস্তৃত হতে পারছে না। পরামর্শ হিসেবে তারা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করে সীমান্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করতে পারলে ‘আসিয়ান’-এর মতো বাণিজ্যিক জোট গড়ে তোলা সম্ভব।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০