Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:57 pm

ধর্মীয় সম্প্রীতির চর্চা দেশকে এগিয়ে নিতে পারে  

কাজী সালমা সুলতানা: ঈদ যায়, ঈদ আসে। পূজা যায়; আবার পূজা আসে। আসে বড়দিন, আসে জন্মাষ্টমী। নানা ধর্মের এমনই সব বর্ণিল পার্বণের মাঝে জীবন চলে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের। এজন্যই বলা হয়, এখানে বারো মাসে তের পার্বণ। যদিও এই প্রবাদটির ‘তের পার্বণ’ বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানকেই  বোঝানো হয়, তবুও এখানে সব ধর্মের মানুষেরই রয়েছে আনন্দঘন ধর্মীয় পার্বণ। আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাধারণত দুটি রূপ লক্ষ করা যায়। একটি অংশ হচ্ছে একেবারেই ধর্মীয় আচার, আরেকটি সামাজিক আচার। এই সামাজিক অংশটুকু ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমা ছেড়ে সমাজের সব মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আনন্দের। সমাজের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করার মাঝে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত উৎসবের আমেজ। ধর্মের এই সর্বজনীন অংশটুকুই সামাজের সব মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে ভিন্ন এক আবহ। আর এ জন্যই বলা হয়ে থাকে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসবের অংশটুকু প্রকৃতপক্ষে সমাজকে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে। সমাজে সৃষ্টি করে সম্প্রীতির বন্ধন।

আবহমানকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে বসবাস করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। রক্তের বন্ধন না থাকলেও একে অন্যের আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর কৃষ্টি এখানকার মানুষের সহজাত। বিশ্বের অন্য কোথাও এমন সহমর্মিতা লক্ষ করা যায় না। এখানকার বাসিন্দারা নিজেরা সাধারণত প্রতিবেশীর জন্য বিপদ বা সমস্যার কারণ হন না, বরং একটি পরিবারের মতোই অবস্থান করে ভিন্ন পরিবারের বাসিন্দা হয়েও। সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান এখানে সব সময় বিরাজমান। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে বসবাস করে; কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য ধর্ম কখনই প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি।

ভারতবর্ষের বাসিন্দাদের এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আর কোনোখানে দেখা যায় না। এ কারণেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনারই প্রতিফলন ঘটার বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাই ধর্মের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বিভেদের রেখা টানা শুরু করে ব্রিটিশ শাসকরা। তাদের শাসনব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করতে ধর্মের বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। যদিও ব্রিটিশ শাসকরা এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর প্রধান যে দুটি ধর্ম হিন্দু ও মুসলমান, তার কোনোটিতেই বিশ্বাসী ছিল না। তবুও এ বিষয়টিকে সামনে টেনে এনে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা। সে সময় থেকেই মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। তারপরও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিভেদ তেমন রেখাপাত করতে পারেনি।

তবে ভারত বিভক্তির ঘটনাটি ঘটে ব্রিটিশদের সৃষ্ট সেই ধর্মীয় বিভেদের সূত্র ধরেই। অথচ ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ধর্ম কখনই বিবেচ্য বিষয় ছিল না। ভারত বিভক্তির জন্য যেসব নেতাকে দায়ী করা হয়, তাদেরও অধিকাংশই ভারত বিভক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। পাকিস্তানের জনক বলে খ্যাত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নিজেও প্রথম দিকে ভারত বিভক্ত করে স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়ে বিশ্বাসী ছিলেন না। পরিস্থিতি ক্রমেই তাকে সেদিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর সেই পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। এই পাকিস্তান সৃষ্টির পর সুখকর অনুভূতি আর পাওয়া যায়নি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ফলে ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। ভারতে মুসলমানদের ওপর এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বা আজকের বাংলাদেশে হিন্দুদের নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। সে সময়ের নেতারা এ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। নেতাদের অপরিণামদর্শিতার কারণে অসংখ্য মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়, যা এ ভূখণ্ডে অতীতে কখনই ঘটেনি। 

প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এখানে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতার পদবি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে আবহমানকালের ঐতিহ্যটি ম্লান হয়ে পড়ে। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অসংখ্য হিন্দু ভারতে এবং ভারত থেকে অসংখ্য মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতায় ধর্মের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম চলেছে ধর্মের বিষয়টিকে পেছনে ফেলে। কারণ, ধর্ম বিশ্বাসে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন চলেছে ধর্মের বিশ্বাসের বাইরে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে তারা নাগরিকের মধ্যে ধর্মের বিষয়টি আর বিবেচনায় রাখেনি। এ দেশের সম্পদ লুটপাটের সাথে এখানে বসবাসরত মুসলমানদের স্বার্থও কুক্ষিগত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেদের দ্বারা। প্রকৃত রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো বিবেচ্য বিষয় থাকে না, তা বিবেচনায় রাখারও কোনো সুযোগ নেই। আর তাই বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচনা করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সব মানুষের, অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণের স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে গেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সব মানুষ জীবনপণ যুদ্ধ করেছে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের প্রাধান্য পাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানও সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্থান পেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয় রাজনৈতিক শঠতার কারণে। স্বাধীনতার চেতনায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে, সেটিও পরিবর্তিত হয়ে যায় ধর্মীয় বিশ্বাস নয়Ñ রাজনৈতিক অসততার কারণে। এ কারণে সম্প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু ঘটনা এ অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ম্লান করে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও প্রতিমা ভেঙে ফেলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে। দেখা যায়, কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব ঘটনার পেছনের হোতা। আমরা  এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবেই দেখতে চাই। তারপরও যখন গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন সংবাদ আসে, তখন কষ্ট লাগে। যারা এসব ঘটনার পেছনের কুশীলব, খোঁজ নিলে দেখা যায় তারা নিজেরা কখনও ঠিকমত নিজের ধর্ম পালন করে না। এরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না; কিন্তু অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের নিজের অশুভ চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়। এরা প্রকৃতপক্ষে নিজের ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানেও না বা নিজের ধর্মের আদেশ-নিষেধও মানে না। এসব অপকর্মের পেছনে থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভয়-ভীতি দেখানো। এভাবে ভয়-ভীতি দিখিয়ে সম্পদ গ্রাস করাই থাকে তাদের মূল লক্ষ্য। মদিনা সনদ সম্পর্কে তারা অবহিত থাকলে বা হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ সম্পর্কে জানা থাকলে প্রতিমা ভেঙে ফেলা বা অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মতো জঘন্য কাজে তারা লিপ্ত হতে পারত না। আবার দেখা যায়, অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে। ভারতে গরু জবাই দেয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করা সে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপির স্থূল রাজনৈতিক অপকর্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়।

একইভাবে ২০০১ সালে আমাদের দেশে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত চারদলীয় জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এরপরও বহুবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্মীয় রাজনীতির এই অপতৎপরতার কারণে শত শত বছর যাবৎ বসবাস করেও ভারতে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে সে দেশে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে পারে না। একইভাবে এ দেশেও এক শ্রেণির রাজনীতিকের কারণে বা কিছু অতিলোভী মানুষের সম্পদ দখলের মানসিকতার কারণে হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এটাই হচ্ছে কূপমণ্ডুকতা।

ইসলাম ধর্মের বড় দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এ দুটি বড় অনুষ্ঠানের একটি অংশ হলো সকালে নামাজ আদায় করা বা সকালে নামাজ আদায় শেষে পশু কোরবানি দেয়া। কিন্তু আরেকটি অংশ হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে মিষ্টান্ন বা মাজাদার খাবার তৈরি করা ও আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝে তা বিলানো বা সবাইকে নিয়ে একসাথে খাওয়া। একইভাবে হিন্দুদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এ পূজায় প্রতিমা তৈরি, তাতে পূজো দেয়া বা প্রতিমা বিসর্জনÑ এসব হচ্ছে যারা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী, তাদের জন্য। কিন্তু এ পূজাকে কেন্দ্র করে যে নাচ, গান, বাজনা, প্রসাদ বিতরণ বা মজাদার খাবার বিতরণ, সেটি কিন্তু সবাই মিলে উপভোগ করা হয়। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই উপভোগ করে। এখানেই ধর্মের সামাজিক রূপ নিহিত। এখানে নিহিত রয়েছে ধর্মের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও সামাজিক বন্ধন সৃদৃঢ় হওয়ার মন্ত্র। এই মন্ত্রই পারে আমাদের দেশে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে দেশকে এগিয়ে নিতে।

সাংবাদিক

salma15august৥gmail.com