ধারাবাহিকভাবে কমছে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য

রোহান রাজিব: দেশে ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৮ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলোর অ্যাকসেস রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কয়েকজন ব্যাংকার বলেছেন, বিল বন্ডে বিনিয়োগ কমা, আমানতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ঋণ বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংক খাতের তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। তাই কিছু ব্যাংক নগদ অর্থসংকটে ভুগছে। ফলে সংকট মেটাতে অতিরিক্ত তারল্যে হাত দিচ্ছে। এজন্য ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত তারল্য কমছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে আট হাজার ১২৮ কোটি টাকা।

জানুয়ারি শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্তি তারল্য ৫১ হাজার কোটি টাকা, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৫৪ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকের ৩২ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারার কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলোর বিল বন্ড ম্যাচিউর হওয়ার পর নতুন করে এ খাতে বিনিয়োগ করছে না। কারণ এখন বিল বন্ডের চেয়ে মানি মার্কেটে সুদ হারের রেট বেশি। তাই যাদের বিল বন্ড ম্যাচিউর হচ্ছে, তারা সে টাকা আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেটে বিনিয়োগ করছে। ফলে অতিরিক্ত তারল্য কমে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে এসেছে। ফলে মানুষ প্রচুর টাকা তুলে নিয়েছে। টাকা তুলে নিজের কাছে রাখার কারণে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এছাড়া সুদহার না বাড়ার কারণে করপোরেট লোন বাড়ছে। যে পরিমাণ আমানত আসছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ যাচ্ছে। এজন্য মার্কেটে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অতিরিক্ত তারল্য কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে সাত মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৪৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।

তবে অতিরিক্ত তারল্য কমলেও ব্যাংকগুলোর অ্যাকসেস রিজার্ভ বাড়ছে। জানুয়ারিতে অ্যাকসেস রিজার্ভ বেড়ে ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

সিআরআর রাখার পরও নগদ আকারে বাড়তি যে তারল্য থাকে, তাকে অ্যাকসেস রিজার্ভ বলা হয়। এ টাকা থেকে ব্যাংক চাইলে ঋণ দিতে পারে।

সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে ডলার সংকটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিল না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এক লাখ ৩ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকটের এটিও অন্যতম একটি কারণ।

অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে। ফলে তারা টাকা জমাতে পারছেন না। এজন্য ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। তাই ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত তারল্য পতন হচ্ছে।

তারল্য কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর আগে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নিয়েছে ৪ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত ৪ থেকে সাত হাজার কোটি টাকা করে ধার করছে। মূলত বাজারে তারল্য সংকট থাকার কারণে এ ধার নিতে হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় স্বল্প সময়ের ঋণ কল মানি রেটের পরিমাণও বেড়েছে। গতকাল আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেট লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, এদিন ৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যার গড় রেট ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৯ বিলিয়নের মতো ডলার বিক্রি করেছে। ফলে বাজার থেকে প্রচুর টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। এজন্য তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট দেখা দেয়ায় অন্যতম একটি কারণ। মানুষের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তারা টাকা জমাতে পারছেন না। এ জন্য আমানত কমেছে। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে। তাই চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত তারল্যে হাত দিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০