ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে মার্কিন ডলারের সংকট চলছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিভিন্ন ব্যাংকের আমদানি চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ৩৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে এ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে কিছু ব্যাংকের চাহিদা মেটাচ্ছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আগামীতে রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে সাপোর্ট দিচ্ছে, তাদের উচিত অন্য ব্যাংকের মতো বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করে আমদানি দায় মেটানো।

জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১০ কোটি ডলার বিক্রি করে। এর ফলে নতুন অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে আমদানি দায় মেটাতে ৩৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় ব্যাংকগুলো থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে উঠে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। মূলত আমদানিতে খরচ বাড়লেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে পতন এবং অনেক বিদেশি ব্যাংকে ঋণসীমা কমানোয় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া আর গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করে ৭৬২ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করেছে ৯৬ টাকা দরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দরে ডলার বিক্রি করছে না ব্যাংকগুলো। গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক গড়ে ১০৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১০৪ টাকা ১০ পয়সায় ডলার বেচাকেনা হয়। চলতি বছরের একই সময়ে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ১৮ টাকা ৬০ পয়সা।

অবশ্য সাম্প্রতিককালে ডলারের সংকট নিরসন ও প্রবাসী আয় বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরাই বসে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় এ দাম নির্ধারণ করে।

বাফেদার ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এখন থেকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা কিনতে পারবে ব্যাংক। বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে প্রতি ডলার ৯৯ টাকায়। এ ছাড়া রেমিট্যান্স আহরণ ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংকগুলোর গড় (ওয়েট অ্যান্ড এভারেজ) মূল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করতে পারবে ব্যাংকগুলো। গত মাস সেপ্টেম্বরে বাফেদা রেমিট্যান্স কেনার সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা।

এদিকে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানি ব্যয় কমাতে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছর আমদানি বাড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১.৫ বিলিয়ন (১৫০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে প্রথম দুই মাস বাড়লেও গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

যদিও সেপ্টেম্বর মাসে আমদানির জন্য এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির হার কমেছে। তবে আগের আমদানি দায় নিষ্পত্তির জন্য কোনো কোনো ব্যাংকে ডলারের সংকট আছে। এ সংকট মেটাতে এবং টাকা-ডলার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। বিশেষত সরকারের বিভিন্ন আমদানিতে সংকট হলে সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়ায় বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে দেশ। সংকট সৃষ্টি হয় মার্কিন ডলারের। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে আসে। অর্থনীতির এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আমদানির লাগাম টানতে নানা শর্ত দেয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যার প্রভাবে ধারাবাহিকভাবে কমছে আমদানি।  চলতি বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে নিষ্পত্তির হারও।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ৫৭০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের মাস (আগস্ট) তুলনায় ৬৩ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ শতাংশ কম। আর সেপ্টেম্বরে এলসি নিষ্পত্তি আগের মাসের চেয়ে ১৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি ডলার। আগস্টে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৩৩ কোটি ডলার।

উল্লেখ্য, কভিড-পরবর্তী সময়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে মাত্র কয়েক মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হয়, যা বৈশ্বিক ডলার সরবরাহে আরও সংকট তৈরি করেছে। আর এর প্রভাব বাড়তে থাকায় আমদানি কমিয়ে ডলার সাশ্রয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানিতে দেয়া হয়েছে নানা শর্ত। আর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আনতে দেয়া হয়েছে ছাড়। তবে এত উদ্যোগের পরও স্বাভাবিক হচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রা বাজার। আর তাই বাজার ঠিক রাখতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ধারাবাহিক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে এটা ফুরাতে বেশি সময় লাগবে না। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে। তা না হলে এক বছরের মধ্যে সংকট দেখা দেবে। সংকট কেটে যাবে এমন আত্মতুষ্টির মধ্যে থাকা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এতে এসব ব্যাংক ৯৬ টাকায় ডলার কেনার সুযোগ দেয়ার ফলে তা হয়তো সরকারের গম ও সার আমদানিতে এক ধরনের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছে। তবে ডলার বিক্রি না করলে এসব ব্যাংককে বাজার থেকে কিনতে হবে। তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চাপে পড়বে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০