Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 4:33 am

ধার করা ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডে সেতু বানাচ্ছে বাংলাদেশ!

ইসমাইল আলী: নব্বইয়ের দশকের আগে দেশে বড় সেতু ছিল না। তবে এক দশকের মধ্যে চালু হয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বড় সেতু মেঘনা, মেঘনা-গোমতী ও বঙ্গবন্ধু সেতু। এরপর দেশের সড়ক অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়নের ফলে মাঝারি ও বড় বিভিন্ন সেতু নির্মাণ হতে থাকে। বর্তমানে নির্মাণ করা হচ্ছে সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু। এরই মাঝে গত বছর উদ্বোধন করা হয়েছে দ্বিতীয় মেঘনা, দ্বিতীয় গোমতী ও দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু। আরও বেশকিছু নির্মাণ করা হয়েছে বা নির্মাণাধীন রয়েছে।

এদিকে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ছাড়াও বরিশাল ও ভোলার সংযোগ স্থাপনে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু (সাড়ে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ) নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার, যদিও বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো ব্রিজ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড নেই। তাই বড় বা মাঝারি আকারের সেতু বানাতে কখনও অনুসরণ করা হয় জাপানের স্ট্যান্ডার্ড, কখনও বা যুক্তরাজ্যের স্ট্যান্ডার্ড। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্রিজ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডও অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ ধার করা ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডে সেতু বানাচ্ছে বাংলাদেশ।

সূত্রমতে, পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন দেশের সর্ববৃহৎ সেতুর নকশা প্রণয়নে অনুসরণ করা হয় ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ম্যানুয়াল। এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর নকশা প্রণয়নেও অনুসরণ করা হয় ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ম্যানুয়াল। আর শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু তিনটির নকশা প্রণয়নে অনুসরণ করা হচ্ছে জাপানের স্ট্যান্ডার্ড। এছাড়া প্রথম মেঘনা ও প্রথম গোমতী সেতু নির্মাণেও জাপানের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হয়েছিল।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চলে রূপসা নদীর ওপর নির্মাণাধীন দেশের সর্ববৃহৎ রেল সেতুর নকশায় অনুসরণ করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্ট্যান্ডার্ড। আবার চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুতে অনুসরণ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড।

নির্দিষ্ট কোনো স্ট্যান্ডার্ড ছাড়া এভাবেই একের পর এক নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের বড় বড় সেতু। আর এগুলোয় অনুসরণ করা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত যে দেশের পরামর্শক নকশা প্রণয়নের কাজ করছে, মূলত সে দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হচ্ছে সেতুতে। এতে একদিকে সেতু নির্মাণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আবার সেতুগুলোর নির্মাণ-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণও দেখা দিচ্ছে জটিলতা।

‘ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অব ব্রিজস ইন বাংলদেশ: ইন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এএফএম সাইফুল আমীন ও জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াই ওকুই। এতে গত ১০০ বছরে দেশে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন সেতুর নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে সেতু নির্মাণে কোনো স্বতন্ত্র জাতীয় ডিজাইন কোড বা স্ট্যান্ডার্ড নেই। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড ‘দ্য আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব স্টেটস হাইওয়ে অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অফিশিয়ালস’ বা এএএসএইচটিও’র স্পেফিকিশেন অনুসরণ করে। বাংলাদেশে ১৯৯২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সেতু নির্মাণে বিভিন্ন ডিজাইনার এএএসএইচটিও’র বিভিন্ন সংস্করণ ব্যবহার করেছেন। ইন্ডিয়ান রোডস কনগ্রেস (আইআরসি) স্পেফিকিশেনও মাঝে মাঝে ব্যবহার করা হয়।

বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালে প্রণীত ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড (বিএস) ৫৪০০ অনুসরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু। এছাড়া নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুতে বিএস ৫৪০০ অনুসরণ করা হয়েছে। আবার দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতুর নকশায় জাপান রোড অ্যাসোসিয়েশনের (জেআরএ) প্রভিশনস ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এতে ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাতাসের গতিবেগ ও ভূমিকম্পের মাত্রার সমন্বয় করা হয়েছে। অর্থাৎ এএএসএইচটিও, বিএস, জেআরএ বা আইআরসি যেক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়, সেক্ষেত্রে ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোডের ব্যবহার করা হয়।

একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে ‘রিসেন্ট ট্রেন্ড অ্যান্ড ফিউচারিসটিক ভিশন অব ব্রিজ ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে। যৌথভাবে এটি প্রণয়ন করেন বাংলাদেশ গ্রুপ অব আইএবিএসই’র চেয়ারম্যান এমএ সোবহান ও বুয়েটের অধ্যাপক এএফএম সাইফুল আমীন।

জানতে চাইলে অধ্যাপক সাইফুল আমীন শেয়ার বিজকে বলেন, নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এখানে প্রচুর সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো ব্রিজ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড নেই। আসলে এর জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সওজ ও এলইজিইডি সেতু নির্মাণে নিজস্ব ব্রিজ ডিজাইন ম্যানুয়াল অনুসরণ করে। তবে এগুলোতে স্পষ্টই লেখা রয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণের কথা। ফলে যে দেশের পরামর্শক সেতুর ডিজাইন সে ওই দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নিজস্ব কোনো ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড না থাকায় বড় বড় সেতু নির্মাণে সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু। এটির ২২টি পিলারের নকশায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। পিলারগুলোর জন্য পানির জিরো ডিগ্রি থেকে ১১০ থেকে ১২০ মিটার গভীর পাইল করতে হয়েছে। তবে পাইলিং করতে গিয়ে এর তলদেশে কাদার স্তর ধরা পড়ে। ফলে এসব পাইলের জন্য স্ক্রিং গ্রাউটিং (খাঁজ কাটা) পাইল করতে হয়েছে। এছাড়া ২২টি পিলারের একটি পাইল বেশি নির্মাণ করতে হয়েছে। পাশাপাশি পাইলের শেষ প্রান্তে কেমিক্যাল দিয়ে মাটির গুণগত মান পরিবর্তন করতে হয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে আরও জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা নদী অত্যন্ত খরস্রোতা বলে সেতুর পিয়ারের (পিলার) স্থলে স্কাউরিং (গোড়ায় মাটি সরে যাওয়া) সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রকল্পটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট টিমের প্রধান সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও এ ধরনের ঝুঁকির কথা একাধিকবার বলেছেন।

তথ্যমতে, পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ২০টিতে রয়েছে ছয়টি করে পাইল। বাকি ২২টি পাইল রয়েছে সাতটি করে। এগুলোর গড় গভীরতা ১০৮ মিটার। তবে খরস্রোতা হওয়ায় পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে এসব পিলারের গোড়ায় ৬০ মিটার (প্রায় ২০০ ফুট) পর্যন্ত গর্ত তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে নদীর তলদেশে কাদার স্তর থাকায় রূপসা রেল সেতু নির্মাণেও জটিলতা দেখা দেয়। এটির খুলনা প্রান্তে বারবার পাইল ফেল করে। পরবর্তীকালে পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন পাইলের পয়েন্টে মাটির অবস্থা খুবই খারাপ। এটি এতটাই খারাপ যে, ডিজাইন লোড বহন করা খুবই কঠিন। এজন্য পরে পাইলের নিচে বেইস গ্রাউটিং করতে হয়। এক্ষেত্রে পাইলের শেষ প্রান্তে মাটি কেমিক্যালের সাহায্যে বিশেষ ধরনের ট্রিটমেন্ট করা হয়।

এদিকে নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড না থাকায় প্রথম মেঘনা সেতুটির ভূমিকম্প-সহনীয় মাত্রা অনেক কম। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখানো হয়, বিল্ডিং কোডে ভূমিকম্প-সহনীয় কোফিসিয়েন্ট দশমিক ১৫। অথচ মেঘনা সেতুতে ভূমিকম্প-সহনীয় কোফিসিয়েন্ট দশমিক শূন্য পাঁচ তথা তিন ভাগের এক ভাগ। বিল্ডিং কোড প্রণয়নের আগে সেতুটি নির্মাণ করায় এ ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল।

এদিকে নকশা ভুল হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতুতেও ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ-সংক্রান্ত বুয়েটের একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুর নকশা প্রণয়নে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড (বিএস) ৫৪০০ অনুসরণ করা হয়। সেতু নির্মাণে ১৯৭৮ সালে প্রণীত এ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, বাতাসে তাপমাত্রা ২৪-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে সেতুর উপরিকাঠামোর (সুপার স্ট্রাকচার) তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩৭ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করবে। এরূপ বিবেচনায় নকশা প্রণয়ন করা হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর, প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।

বুয়েটের গবেষণায় দেখা যায়, বাস্তবে গ্রীষ্মকালে সেতুটির সুপার স্ট্রাকচারের তাপমাত্রা ১৯ থেকে ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে। আর শীতে এ তাপমাত্রা ১৩ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। আবার গ্রীষ্মে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি এলে ঘণ্টার ব্যবধানেই তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। তাপমাত্রার এ ধরনের পার্থক্য সেতুটির নকশা প্রণয়নের সময় বিবেচনা করা হয়নি। এতে সেতুটির ডেক সø্যাবে ব্যবহার করা রডের সংকোচন ও প্রসারণ ব্যাহত হয়। ফলে নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই সেতুতে ফাটল দেখা দেয়। পরবর্তীকালে এসব ফাটল ক্রমেই বড় হয়েছে ও সংখ্যায় বেড়েছে। এছাড়া অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে সেতুটির মেরামত কাজও একাধিকবার ব্যাহত হয়।

জানতে চাইলে গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল আমীন বলেন, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড হুবহু বাংলাদেশে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কারণ বাতাস, তাপমাত্রা, আর্দ্রতাসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের ভিন্নতা রয়েছে। ফলে বঙ্গবন্ধু সেতুর নকশায় কিছুটা ত্রুটি ছিল। তবে ফাটল মেরামতের সময় এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।