ধূমপান না করেও বড় জনগোষ্ঠী এর পরোক্ষ ক্ষতির শিকার

মো. জিল্লুর রহমান: প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। অন্তত ২৪ ঘণ্টা তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটির প্রচলন করা হয়েছে। এছাড়া দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে।

সবাই জানে ধূমপান করলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু তারপরও জেনেশুনে মানুষ যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। একটি গবেষণায় জানা গেছে, শিশু-কিশোররাও এখন প্রতি দশজনে একজন ধূমপায়ী। শুধু ধূমপানই নয়, তারা নানা রকমের নেশাও করে এবং ধূমপানের মাধ্যমেই যেকোনো নেশা শুরু হয়। এতে যেমন তাদের দেহের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশের অন্য মানুষের দেহেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ১৩২ কোটি। তার দু’বছর পর ২০২০ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ১৩০ কোটিতে। যে হারে এই সংখ্যা কমছে, তাতে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা ১২৭ কোটিতে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে মারা যায় আট কোটিরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ছয় কোটি ৮০ লাখ মানুষ মারা যায় সরাসরি ধূমপানের কারণে। বাকি এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ধূমপায়ী ব্যক্তিদের সংস্পর্ষে থাকার কারণে মারা যায়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সাত বছরের মধ্যে বিশ্বে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে। গোটা বিশ্বে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার নিরিখে ধূমপায়ীদের সংখ্যা এতটা পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় যথেষ্ট আশাবাদী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতি বছর ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমছে, এটি খুবই উৎসাহব্যাঞ্জক একটি ব্যাপার এবং এতে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ সালে ১৫-১৬ বা ১৮-১৯ বছর বয়সী যেসব কিশোর-কিশোরী ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, ২০২৫ সালে তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনই এই বদ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবে।

সিগারেটের প্যাকেটেও লেখা থাকেÑ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি হয়’, ‘ধূমপান মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়’, ‘ধূমপান হƒদরোগের কারণ’, ‘ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়’ প্রভৃতি। এসব সতর্কতা সত্তে¡ও মানুষ ধূমপান ছাড়ছে না। অনেক জায়গায় লেখা থাকে যে ‘ধূমপানমুক্ত এলাকা’, কিংবা এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেকে তা খেয়াল করার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে মনে হয় যেন প্রতিবাদকারীই আসল অপরাধী।

জনসমক্ষে ধূমপান আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এ আইন মানে না। এতে অধূমপায়ী ও শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে প্রকাশ্য ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। এদিকে প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়নের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ‘অকালজাত শিশু’ জšে§র হার প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে বলে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

আইন অনুসারে জনসমক্ষে, বিশেষ করে গণপরিবহন, বার, রেস্তোরাঁ এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধূমপানবিরোধী আইন প্রয়োগের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব পড়েছে, সে বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, এ আইনের ফলে এরই মধ্যে বয়স্কদের ক্রমাগত ধূমপানের প্রবণতা কমে গেছে। আজকাল শিশুরাও ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যালয় থেকে বের হয়েই তারা দোকান থেকে বিড়ি বা সিগারেট কিনে তা টানতে টানতে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। স্কুলের বাইরে কেউ কিছু বলবে না, এই ভেবে তারা ধূমপান করে। এর ফলে অধূমপায়ী ছাত্রদের ওপরেও খারাপ প্রভাব পড়ছে।

ধূমপানের কুফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্যানসার ও শ্বাসকষ্ট। আজকাল এসব রোগের আক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে মানুষের মৃত্যুসংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। ধূমপানের ফলে ফুসফুসে ও শ্বাসনালিতে নানা রোগ আক্রমণ করে। ধূমপায়ী বাবা-মায়ের সন্তানেরাও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ধূমপানের জন্য বিশ্বে প্রতি বছর মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ই মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি লোক। আর তাদের অর্ধেকই ছিল যুবকশ্রেণি। সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে, তা হিরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী। ধূমপানকারী পরিবার, দেশ ও সমাজ সর্বমহলে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হয়। ধূমপান হলো সবচেয়ে বড় অপচয় এবং নিয়মিত ধূমপান মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে। কারণ সে নিশ্চিত জানে, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তারপরও সে তা পান করে। ধূমপায়ী তার ছেলে-সন্তান ও উত্তরসূরিদের জন্য একজন আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

ধূমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমগ্র পৃথিবীতে ধূমপানের কারণে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, অন্য কোনো রোগ-ব্যাধির কারণে তত ঘটে না। ধূমপানের কারণে শরীরে তাপ বৃদ্ধি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগ-ব্যাধি দেখা যায়। ধূমপানের কারণে রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং অনেক সময় তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপানকারীর ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিভ ও কণ্ঠনালি, কিডনি ইত্যাদি অংশে ক্যানসার হয়। ধূমপান স্মরণশক্তি, মনোবল ও ইন্দ্রিয় ক্ষমতাও দুর্বল করে দেয়। বিশেষ করে ঘ্রাণ নেয়া ও স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা লোপ পায়।

ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমে যায়। উইনকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় তিন হাজার ৭৫০ মানুষের ওপর এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে লক্ষ করা যায়, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমার আশঙ্কা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। গবেষকরা আরও দেখেছেন, কোনো ধূমপায়ীর ধূমপান করার সময় কোনো অধূমপায়ী উপস্থিত থাকলে তারও একই সমস্যা দেখা দেবে।

ধূমপানের ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বারবার সে হƒদরোগে আক্রান্ত হয়। ধূমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। হার্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো বøক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধূমপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হতে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে মূত্রথলি য²ায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাব বিষাক্ত হয়।

ধূমপান নির্মল পরিবেশকে দূষিত করে। এর ফলে স্ত্রী-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব ও আশেপাশের লোকজনের কষ্ট হয়ে থাকে। বাসে, ট্রেনে ও অন্যান্য যানবাহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করার ফলে অনেক সহযাত্রী নীরবে কষ্ট সহ্য করে মনে মনে ধূমপায়ীকে অভিশাপ দেয়। আবার কেউ প্রতিবাদ করে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমানিত হয়। জেনে রাখা উচিত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ধূমপানকারীর প্রতিবেশী শারীরিকভাবে ধূমপায়ীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তামাকজনিত ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর কারণে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৩০ বছর বা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী চার লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত রোগে ভুগছে। তাদের ৬১ হাজারেরও বেশি (১৪ শতাংশ) শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭১৮ জন, যা জাতীয় পর্যায়ে সব মৃত্যুর প্রায় ১৪ শতাংশ। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে ব্যয় বাড়ে চার হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারি ব্যয়, অক্ষমতা/অসুস্থতার কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি এবং অকালমৃত্যুর কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েল বিয়িংয়ের মতে, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান আইনটি সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এত দিনে বদলে গেছে দৃশ্যপট। অনেকেই আবার জনসমাগম স্থলে ধূমপান শুরু করছে। এটা কমাতে করের হারও বাড়ানো প্রয়োজন। তাই আইন সংশোধন জরুরি। সংসদের প্রায় ১৫৩ সংসদ সদস্য এরই মধ্যে তামাকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেছে। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।’

আজকাল ধূমপান রোধের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন টিভিতে প্রচার, নানা স্থানে ধূমপান রোধের পোস্টার লাগানো, ধূমপান রোধের জন্য নানা সংগঠন তৈরি প্রভৃতি। ধূমপায়ীদের অনেকের পরিবারের অভিভাবকরা একথা জানেন, আবার অনেকের পরিবারের অভিভাবকরা তা জানেন না। যাদের পরিবারের অভিভাবকরা একথা জানেন না, তারা একথা জানার চেষ্টাও করেন না যে, তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে কী করছে। এর ফলে তারা আরও ছাড় পায়। ?

ধূমপানে বিষপান। এটা জীবন ও শরীর উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীর মতো তার পাশে থাকা অধূমপায়ীও সমান ক্ষতি ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে ধূমপান রোধের জন্য সবার আগে নিজেদের সচেতন করতে হবে এবং অভ্যাস বদলাতে হবে। আসুন আমরা সবাই ধূমপান ছাড়ি, ঝুঁকিমুক্ত জীবন গড়ি এবং ধূমপানকে ‘না’ বলি।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০