জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মেঘনা নদী থেকে অবাধে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির রেণু পোনা আহরণ করা হচ্ছে। এতে প্রতিদিন চিংড়ি রেণু নিধনের পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য পোনা। বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত তিন মাস মেঘনায় পোনা ধরা নিষেধ থাকলেও মেঘনা পাড়ের হাজার হাজার জেলে অবাধে চিংড়ি পোনা আহরণ করছে।
তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এবং কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন পোনা নিধনকারীদের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। আর এ তিন মাসে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা মূল্যের মৎস্য সম্পদ ও জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, মেঘনার তীরবর্তী এলাকার ছোট শিশুরা হাতে বই, খাতা ও কলম না ধরে কাঁধে তুলছে জাল। শিশুশ্রমের ব্যাপারে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তার ছোঁয়া লাগেনি এ অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। মেঘনা নদী থেকে রেণু পোনার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে কেন্দ্র করে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে শিশু জেলের সংখ্যা। আর অবাধে রেণু পোনা নিধনের কারণে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে মেঘনা নদীতে এ মৌসুমে কাক্সিক্ষত মাছ না পাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জোয়ার-ভাটা হিসাব করে প্রতিদিন দুই দফায় মেঘনা নদীর পারের শিশুসহ প্রায় ২০ হাজার জেলে মশারি, নেটজাল, ছাঁকনি ও চাদর দিয়ে পানি ছেঁকে এ পোনা শিকার করছে। এ সময় চিংড়ি পোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির রেণু পোনাও নষ্ট হচ্ছে। মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে জেলেরা সব বাধা-নিষেধ অমান্য করে রেণু পোনা আহরণ করছে। ফলে দিন দিন মেঘনা নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতির আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের হাইমচর পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী এলাকায় গলদা চিংড়ি পোনার অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত তিন মাস মাছের পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে রায়পুর উপজেলার হাজীমাড়া পর্যন্ত মেঘনা নদী ও সংযোগ খাল থেকে কোটি কোটি টাকার মৌসুমি গলদা চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ করছেন কিছু অসাধু আড়তদার ও জেলে। শুধু তাই নয়, এ মৌসুমে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর পাড়ে পোনা শিকারের জন্য প্রতি ১০ হাত জায়গা ২০ হাজার টাকা দিয়ে আড়তদারদের কাছে ইজারা দেন।
এদিকে মেঘনা নদী থেকে আহরিত চিংড়ি চাষের জন্য অত্যন্ত মানসম্মত। তাই ঘেরের জন্য সবচেয়ে লাভবান এবং নিরাপদ এ প্রাকৃতিক রেণু। জেলার ছোট-বড় ২০টি নদীর ঘাট থেকে নৌপথ ও সড়কপথে রেণু পাঠানো হয়। ভোলা, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় চিংড়ি পোনার দাম ও চাহিদা বেশি। আর মহাজনরা অগ্রিম ঋণ দেওয়ায় পোনা শিকারে জেলেদেরও দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে।
জানা গেছে, মেঘনায় প্রতিদিন জেলে ও শিশুরা জাল ফেলে পোনা আটকানোর পর থালাতে নিয়ে চামচ বা শামুকের খোলসের মাধ্যমে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে। আর থালায় মারা যাচ্ছে অন্যান্য সামুদ্রিক ও নদীর মাছের পোনা। প্রতিটি চিংড়ি পোনা এক থেকে দেড় টাকা দরে বিক্রি করে তারা প্রতিদিন আয় করেন ৪০০-৫০০ টাকা। প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি ‘সাদা সোনা’ নামে গলদা চিংড়ির পোনা আহরণ করেন জেলেরা, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা।
খুলনা থেকে চিংড়ির রেণু কিনতে এসেছেন হোসেন মাঝি। তিনি জানান, লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদী থেকে আহরণকৃত চিংড়ির পোনার মান উন্নত। এ পোনাগুলো খুব দ্রুত বড় হয়। এ কারণে ঘেরমালিকদের কাছে এর চাহিদাও বেশি থাকে।
রামগতির বালুর চর এলাকার বাসিন্দা মো. হাসান জানান, ইলিশ, কোরাল, পোয়া, চেউয়া, লইট্টা, ভেটকি, পাঙাশ, রিটা, পাবদাসহ নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির মাছ পোনা শিকারিদের জালে প্রতিদিন নষ্ট হতে দেখছেন তিনি। একই উপজেলার আলেকজন্ডার এলাকার নদীর পারের বাসিন্দা ছালেহা জানান, প্রতিদিন নদীতে দুবার সকাল-সন্ধ্যায় জোয়ারের পর কমপক্ষে চার ঘণ্টা ভাটা থাকে। তখনই রেণু পোনা ধরা হয়। এ মৌসুমে শুধু এক দিন কোস্টগার্ড কর্তৃক নদী থেকে পোনা শিকারিদের তাড়িয়ে দিতে দেখেছেন তিনি।
মেঘনার বুকের দ্বীপ চর কালকিনিতে পোনা শিকারি কিশোর জামাল মশারি জাল টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এক ঘণ্টার মধ্যে সে প্রতি ৫-১০ মিনিট পরপর ওপরে উঠে আসে। প্রতিবার দেখা যায়, একেকটি বাগদা চিংড়ি পোনার সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পোনা-ডিম মশারির জালে উঠে আসে। ওই কিশোর বাগদা পোনা নেওয়ার পর অন্য ছোট মাছ ও জীবগুলো নদীর তীরেই ফেলে আবার পোনা শিকারে নদীতে চলে যায়।
কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল্লাহ জানান, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মেঘনা পাড়ের জেলেরা মশারি, নেটজাল, ছাঁকনি ও চাদর দিয়ে পোনা আহরণ করে। জালগুলো ঘন সুতায় তৈরি বলে এতে মাছের ডিম পর্যন্ত উঠে আসে। জেলেরা কোটি টাকার গলদা চিংড়ির পোনা ধরলেও কয়েকশ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা নিধন করে যাচ্ছে।
অবাধে রেণু পোনা আহরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন জানান, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এ মৌসুমে মেঘনাপারের শিশুসহ শিকারিরা পোনা শিকার করছে। ব্যবসায়ীরা পোনা কেনার কারণে স্থানীয়রা ধরে, আর সেজন্যই মূলত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। তবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।