Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 4:05 pm

ধ্বংস হলো দেশীয় শিল্প

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।   পর্ব-৪

মিজানুর রহমান শেলী: ভারতকে শোষণ করার বহুরূপী ফাঁদ পেতেছিল ব্রিটিশরা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সব দিক দিয়ে তারা ভারতবাসী তথা বাঙালিকে শুষে খাওয়া শুরু করে। এরকম একটি কঠিন ষড়যন্ত্র ছিল এ দেশের শিল্প খাতকে একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া। তারপর এ দেশে ইউরোপীয় পণ্যের বাজার তৈরি করা। যদিও এ দেশের কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তারা প্রথম এসেছিল। ধীরে ধীরে সেই কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টির প্রক্রিয়াও তারা নিজ হাতে বুলন্দ করতে শুরু করে। সেই থেকে বাংলার মসলিনসহ আরও দেশীয় শিল্প খাতগুলো ধ্বংস হতে থাকে।

অনেক ভারতীয় লেখকই দাবি করেন, ব্রিটিশরা ভারতের শিল্প খাতকে ধ্বংস করেছে। একইভাবে আরসি দত্ত দাবি করেন, ‘১৮ শতকে ভারত ছিল বিশাল এক শিল্পোৎপাদনমুখী ও কৃষিনির্ভর দেশ। ভারতের উৎপাদিত লুম-পশম এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল বাজারে সরবরাহ হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে এটা সত্যি যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১০০ বছর আগের স্বার্থান্বেষী বাণিজ্যিক নীতি অবলম্বন করার মাধ্যমে ভারতে তাদের সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার শুরুতেই শিল্পোৎপাদন খাতকে নিরুৎসাহিত করে। এর কারণ ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পোৎপাদন খাতকে উৎসাহিত করা। আঠার শতকের শেষের দশক ও উনিশ শতকের শুরুর দশকে ভারতে প্রয়োগকৃত তাদের পূর্ব নির্ধারিত নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের শিল্প-কারখানার দাসত্বে পরিণত করা এবং ভারতের জনগণকে ভারত থেকে লুম-পশম ও কলকারখানার কাঁচামাল গ্রেট ব্রিটেনে পাঠানোর কাজে ব্যবহার করা।’

আর. পাল্মি দত্ত দাবি করেন, সেই প্রক্রিয়া এখন চলমান: ‘আধুনিক ভারতের চিত্রটা হলো সেই চিত্র যে চিত্রকে এক সময় যথাযথভাবেই ‘বি-শিল্পায়ন’ বলে ডাকত; এর মাধ্যমে আধুনিক শিল্প খাতকে প্রণোদনা না দিয়েই প্রাচীন কুটিরশিল্পকে বন্ধ করে দেওয়া হতো। মিল-কারখানার অগ্রগতির মাধ্যমে প্রাচীন কুটির শিল্পের চাহিদা মিটমাট হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। কার্যত উনিশ শতকের ধ্বংস প্রক্রিয়া বিশ শতক ও যুদ্ধ-পরবর্তী সময় পর্যন্ত অগ্রবর্তী হয়েছে।’

নেহরু দুই দত্তের মতো করেই ভারতের বি-শিল্পায়নকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দাবি করেন, ব্রিটিশরা ভারতে বি-শিল্পায়ন করে, আর এটা হলো, ‘ভারতের জনগণের মাঝে দরিদ্রতা আছড়ে পড়ার মৌলিক কারণ, এবং এটা মোটামুটি সাম্প্রতিক সময়ের তুলনামূলক চিত্র।’

বি-শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একটি কথা যৌক্তিক ব্যবচ্ছেদে সত্যি যে, মোগল ভারতে এক বিশাল শিল্পায়ন হয়েছিল, যা ইউরোপের উপনিবেশিক হয়ে ওঠার জন্য শিল্পায়নের চেয়েও অনেক বেশি। মোগল ভারতের রফতানি-শিল্পায়ন ছিল এক অনন্য ব্যাপার। এ ধারাটি ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের হাতেই ধ্বংস হয়।

যাহোক, একটি বিষয় নিখুঁতভাবে বোঝা দরকারÑকীভাবে বি-শিল্পায়ন শুরু হলো এবং এর প্রভাব বিভিন্ন সময়কালে কীভাবে পড়েছিল। খুব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যে-যে বিষয়গুলো ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছিল এবং পরিবর্তনের চাহিদা ও প্রযুক্তিকে অবহেলা করেছিল তার কুপ্রভাব সব সময়ই ছিল সাধারণ; এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক কৌশলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করে।

১৭৫৭-১৮৫৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা মোগল আদালত ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে; তাছাড়া তারা ভুস্বামীদের আওতার বাইরে সব সেনা-আভিজাত্য উচ্ছেদ করে। অর্ধেকের বেশি জামিন্দার ব্যবস্থা নির্মূল করে সেই স্থলে ইউরোপীয় ধাঁচের বুর্জোয়া গোষ্ঠী তৈরি করে। এই বুর্জোয়ারা ইউরোপের পোশাক ও জুতা পরত, আমদানিকৃত বিয়ার-মদ-স্পিরিট পান করত এবং ইউরোপীয় অস্ত্র ব্যবহার করত। এই নব্য ফ্যাশন বা হালচাল ভারতের ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ অনুকরণ করতে থাকে। এ শ্রেণিটা হলো ওই বুর্জোয়াদের পিয়ন বা চাপরাশি, চাকর-বাকর। এই রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে তিন-চতুর্থাংশ নিত্যব্যবহার্য কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধ্বংস প্রলয়ে মসলিন, জুয়েলারি, উন্নত পোশাক ও জুতা, অলঙ্কৃত তরবারি এবং অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ওই সময় এসব পণ্য জাতীয় আয়ের কতটুকু পূরণ করত সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে ব্রিটিশ ম্যাক্রো-ইকোনমিক হিস্ট্রিয়ান মেডিসন এ ব্যাপারে তার একটি অনুমান উপস্থাপন করেন। তার মতে, দেশীয় বাজার থেকে এসব পণ্যে পাঁচ শতাংশ এবং এসব পণ্যের রফতানি খাতে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ আয় জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হতো। কিন্তু এসব পণ্যের প্রায় শতভাগ বাজার ও উৎপাদন ধ্বংস হয়ে যায়। ফরাসি বিপ্লবের পর পোশাক-আশাকে রুচি পরিবর্তনের ফলে ইউরোপে এসব পণ্যের চাহিদা কমে। তাছাড়া ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল প্রযুক্তিতে বিপ্লব সাধিত হওয়ায় সাধারণ পণ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে ধস নামে।

দ্বিতীয়বারের মতো ভারতীয় শিল্প-কারখানার বিশাল ধস নামে যখন নেপোলিওনীয় যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর পরিমাণে সস্তা দরে কাপড় এ দেশে আমদানি হতে থাকে। ১৮৯৬-১৯১৩ সালের মধ্যে ভারতে যে পরিমাণ পোশাকের চাহিদা ছিল তার ৬০ শতাংশ আমদানি পণ্যনির্ভর হয়ে পড়ে। এর পরিমাণ উনিশ শতকজুড়ে ছিল ৪৫ শতাংশ বা তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি পরিমাণে। অবসর সময়ে গৃহে নারীদের উৎপাদিত হাতে বুনানো পোশাকের চাহিদা একেবারে নিচে নেমে যায়। যদিও অনেকে মেশিনে বুনানো পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তবুও গ্রামের কারিগরদের হ্যান্ড-লুম উইভারসের চাহিদা বিশাল পরিসরে ধস নেমেছিল। তারপরও ১৯৪০ সালের দিকে ভারতের ব্যবহƒত ছিট কাপড়ের তিন শতাংশই ছিল হাতে বোনা।

নতুন এই মেশিনে বোনা কাপড় অনেক বেশি সস্তা এবং হাতে বোনা কাপড় অপেক্ষা মানসম্পন্ন ছিল। তাই হাতে বোনা পোশাকশিল্পের চাহিদা ও উৎপাদন ব্যাপকভাবে নিচে পড়ে গেল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, মোগল আমলের চেয়ে ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে ভারতে পোশাকের ভোক্তা বেড়েছিল। তবে এই বৃদ্ধির পরিমাণ কেমন ছিল সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মাথাপিচু একটি কাপড়ের জায়গা যদি তারা দুটি কাপড় ব্যবহার করা শুরু করে, তবে বলতে হয় হাতে বোনার স্থলে মেশিনে বোনা কাপড় ব্যবহারের যে প্রভাব পড়েছিল তা আস্তে আস্তে কমে যায়। কারণ এই প্রভাবটি প্রথম দিকেই বেশি প্রকট ছিল বলে জানা যায়। কেননা ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় তিন শতাংশ কাপড় হাতে বোনা হতো।

এ সময়ে ভারতে কাপড় প্রস্তুতকারী বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। ফলে ব্রিটেন থেকে আমদানি কাপড়ের জায়গা আবার দেশীয় মেশিনে তৈরি কাপড় দখল করে নেয়। কিন্তু কারখানা গড়ে ওঠা পর্যন্ত কয়েক দশকের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। এমনকি এরও ১৩০ বছর পর ব্রিটেনের পোশাক আমদানি বন্ধ হয়। ভারত খুব দ্রুত ল্যাঙ্কশেয়ারের প্রযুক্তি অনুকরণ করে আমেরিকার ও ফ্রান্সের মতো বাজার ব্যবস্থায় একটি নীতিমালা তৈরি করতে পারত। আমেরিকা ও ফ্রান্স এটা ১৯ শতকের শুরুর দিকেই করেছিল। অথচ ব্রিটেন উš§ুক্ত বাজার ব্যবস্থার এক দুষ্টু নীতি চালু করে। ব্রিটেনের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে করমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে থাকল। এমনকি যখন একটি কর আদায়ের লক্ষ্যে একটি ক্ষুদ্র নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো, তখন ব্রিটেন আবগারি শুল্ক বসিয়ে দেয় ভারতীয় পণ্যের ওপর। ফলে দেশীয় পণ্য বেশি লাভের মুখ দেখতে পারে না। নিঃসন্দেহে এটা শিল্প-উদ্যোগ বা শিল্পোন্নয়নের জন্য বড় বাধা। যদি ভারত স্বাধীন হতো তবে তাদের কর ব্যবস্থাটি নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো। ১৮৮০ সালে ভারতের বাণিজ্য খাতে বহিঃশুল্কের পরিমাণ ছিল মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ; এটা যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বনি¤œ হার। ওই সময়ে ব্রাজিলে এর পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ। যদি ভারত নিজস্ব বাণিজ্য খাতে নিরাপত্তা পেত তবে পোশাকশিল্পে ভারত অনেক আগেই যাত্রা শুরু করে বিস্তৃতি লাভ করত।

এভাবেই ঘৃণ্য শোষণ যন্ত্রে ইংরেজরা বাঙালিদের দেশীয় পণ্য ধ্বংস করে দেয়। ফলে ঢাকাবাসী দিনে দিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এমনকি বেশিরভাগ মানুষ এখানকার আবাস ছেড়ে অন্য কোনো শহর বা নগরে পাড়ি জমায়। ফলে ঢাকার আবাসন এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রাণ হারিয়ে ফেলল। নির্মাণ ও উন্নয়ন থমকে গেল। পুরো নগরটাই দিনে দিনে চঞ্চলতা হারিয়ে স্থির হয়ে পড়ল।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।