নওশেরা ও করাচির সেনাছাউনিতে জীবন

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৩১

মিজানুর রহমান শেলী: বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের আধা সামরিক জীবন রণদার তৃষ্ণাকে মেটাতে পারেনি। আবার বাঙালি রাজনীতিকরাও বাঙালিদের পরিপূর্ণ সৈনিকের বেশে না দেখা অবধি শান্ত হতে পারছিলেন না। ফলে দাবি-দাওয়া আলোচনা প্রস্তাবনার ভেতর দিয়ে তারা বাঙালি পল্টন গড়ে তোলেন। এই বাঙালি পল্টনে যোগ দেওয়ার পেছনে বাঙালি যুবকদের কালিমা মোচন, দেশপ্রেম ও উত্তম পেশান্বেষণের সবই প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। রণদা প্রসাদ সাহা এই চাল-চিন্তার বাইরে ছিলেন না। তবে তার গভীরতা ও অনুভূতি ছিল অনন্য। সেই স্বাক্ষর তিনি কুট-আল-আমারা, টেসিফন ও বাগদাদে রেখেছিলেন। প্রশংসা, উৎসাহ আর স্বীকৃতির সবটুকু রণদাকে দিতেও কোনো দেশি বা বিদেশি কার্পণ্য করেনি। ফলে রণদার আত্মত্যাগ, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম আর দুঃসাহসিক কাজের প্রতি আকর্ষণও বেড়ে গিয়েছিল ঢের। তাই মেসোপটেমিয়া থেকে ফিরে এসে রণদাসহ অন্যরা কেবল বাঙালি পল্টনে যোগই দেননি, বরং ডবল কোম্পানিতে সৈন্যভর্তির কাজে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে সহযোগিতাও করে।

১৯১৬ সালের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। এ সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের যুদ্ধফেরত সাতজনের তিনজন বাঙালি পল্টনে যোগ দিল। ধারণা করা যায়, রণদা প্রসাদ সাহা তাদের একজন। সৈনিক ফণীভ‚ষণ দত্তও এ সময়ে অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর যোগ দেন। ফণীভূষণ সে সময়ের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে লিখেছেন, প্রাতে নয়টা থেকে এগারোটা এবং অপরাহ্নে আড়াইটা হতে পাঁচটা পর্যন্ত প্যারেড অথবা কুচকাওয়াজ শিক্ষা নিতে হতো। কাজেই স্নান ও তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার সময় পাওয়া যেত না। বৃহস্পতি ও রোববার ছুটি পেতাম। রাত ১০টার পর আলো জ্বালাতে দেওয়া হতো না। নওশেরাতে শীতের প্রকোপ ছিল ভয়ানক। ভোর ৮টার আগে শয্যা ত্যাগ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ড্রিলের সময় বন্দুকও ধরা যেত না [মালঞ্চ, মাঘ ১৩২৫]।

তবে নওশেরা জায়গাটি ছিল বড়ই নয়নাভিরাম। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা। উত্তরে বিশালাকার হিন্দুকুশ পর্বত। ঠিক আধ মাইল মাড়িয়েই চোখে বাধে কাবুল নদী। কুল কুল শব্দে আর সৌন্দর্যে বহতা এ স্রোতস্বিনী যতই নন্দনে আনন্দ জোগাক না কেন, তার স্পর্শের শীতলতা বরফসম অচ্ছুত। ও-নদীর জলে কোনো বাঙালি সৈনিক সাঁতারের সুখ সম্ভোগ করেনি। বাঙালি সৈনিকেরা নওশেরার পথ-ঘাট পরিভ্রমণেও মজা পায়নি কখনও। কেননা রাস্তার উড়ন্ত-উচ্ছন্ন ধুলা-ময়লা গা-গতরে লালচে আভায় আভায় আভরণ ফেলে দিতো নিমিষে। তবে রাস্তায় সব সময় ‘টোঙ্গা’ গাড়ি পাওয়া যেত বলে যাতায়াত ছিল সহজ। অনতিদূরের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু ছিল স্বস্তা ও সহজলভ্য। সৈনিক ফণীভ‚ষণের বর্ণনায় সেখানকার দুর্ধর্ষ পাঠান নর-নারীর রূপ-যৌবনের প্রশংসা ফুটে ওঠে। তিনি পাঠান নারীর কোমল ও পেলব ভুজাবলির প্রেমে বাঙালি নারীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন সহসা। তবে ফণীভ‚ষণের আত্মতৃপ্তির বিষয় ছিল বাঙালি সৈনিকদের শিক্ষা-দীক্ষার সম্মান। পাঞ্জাব, শিখসহ সবাই বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে সম্মান বা কদরের ভাষায় কথা বলতেন। কেননা বেশিরভাগ বাঙালিই ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবা। এ সময় নওশেরায় বাঙালি সৈন্যরা বিকেলে ফুটবল খেলত। অন্য সেনাদলের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতাও চলত। আবার যারা খেলাধুলা করত না তারা কাবুল নদীর ধারে কিংবা আশেপাশের পাহাড় ও উপত্যকায় বেড়াতে যেত। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য সন্ধ্যাবেলা সৈনিকরা ব্যারাকে গান-বাজনা, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি করত। বাঙালি পল্টনে কেউ কেউ পেশাদার শিল্পীর মতো গান-বাজনা ও অভিনয় করতে পারত। এ বিষয়ে সৈনিক মনবাহাদুর ‘সৈনিক বাঙালি’তে লেখেন, সন্ধ্যাবেলা আমাদের বেশ আনন্দে কাটত। দিনের সব ক্লান্তি ভুলে আমরা গান-বাজনা, অভিনয়, আবৃত্তি প্রভৃতিতে চিত্রল লাইনের ব্যারাকগুলো আনন্দে মাতিয়ে তুলতাম। ছেলেদের আরেক গুরুদেব হয়েছিল বিমল সিংহ। বিমল সিংহ আমাদের সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনের মতো কৌতুক অভিনয় করত। এমনকি নওশেরায় বাঙালি সৈনিকেরা ‘শাহজাহান’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন।

অবশ্য নওশেরায় বাঙালি সৈনিকদের প্রথম দিকে কিছু কষ্ট শিকার করতে হয়েছে। রান্নার কাজটা প্রথম দিকে নিজেদেরই করতে হতো। মুসলিম সৈন্য বৃদ্ধি পেলে তাদের জন্য আলাদা খাবারের ব্যবস্থা শুরু হয়। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা নিজেরাই রান্না করে খেতেন। সৈনিক মনবাহাদুর লেখেন, মাইনে ছিল এগারো টাকা। খাবার খরচ এ মাইনের মধ্যেই নিজেদের চালাতে হতো। ফলে মাস শেষে বেনিয়ারা খাবার খরচ কেটে নিলে এগারো টাকার মধ্যে এক কিংবা দু’আনা করে অবশিষ্ট থাকত। কিন্তু শিগগির এই সংকট দূর হয়। পরবর্তী সময়ে তারা সরকারি রেশন পেতে থাকে। তবে ফণীভ‚ষণ লেখেন, রেশনের ডাল-রুটি খেয়ে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত। ভাত-মাছের বাঙালি কখনওবা ভেতো বাঙালিও যাদের বলা হয়, তাদের কি আর রুটি-ডালে পোষায়! তবে কেবল রুচির কথাটাই মুখ্য নয়, চাহিদামতো খাবার যে তারা পেয়েছিল তাও বলা চলে না। সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ এসব নিয়ে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লেখেন:

কেউ এল জেনে শুনে দিবে প্রাণ রণে,

কেউ এল পেস্তাঙ্গুর খাবে প্রাণ পণে,

কেউ এল ফৎনা নিয়ে ধরিবারে মাছ,

কেউ এল ফল খাবে উপড়ায়ে গাছ।

কোথায় আঙ্গুর-পেস্তা! কোথায় বাদাম!

গন্ধ তার দূরে থাক, – নাহি তার নাম!

মাছের কথাটি থাক, আসের সন্ধান

পেতে যদি চাও খোঁজ শ্রীমৎসপুরাণ।

আলু মুলো প্যাঁজ ছাড়া আর নেই গতি,

দূর ছাই তাও ভালো পেলে দিন প্রতি!

রান্নাঘরে কান্না আসে, Ñকাঠ সব কাঁচা,

অস্থির ধোঁয়ার চোটে দায় হল বাঁচা।

নুনে পোড়া ডাল আর কঠিন চপাটি,

হাসিমুখে পেটে পুরে সারাদিন খাঁটি। [বাঙালির রসবোধ, ভারতী, আষাঢ় ১৩২৪]

এ সময় বাঙালি পল্টনে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আর পদানুক্রমটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তাই ডিসেম্বরের শেষ ভাগ থেকেই বাঙালি সৈন্যদের মধ্য থেকে পদন্নোতি দেওয়া হলো। মুহাম্মদ লুৎফুল হকের তথ্য মতে, আটজন ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হয়। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর থেকে আসা সদস্যরা ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাই তারা এক্ষেত্রে গুরুত্ব পেলেন। আবার এদের কেউ কেউ এ দফায় পদোন্নতি পেয়ে গেলেন। ধারণা করা চলে, রণদা এ সময় ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এ ধারণার প্রধান যুক্তি হিসেবে মুহাম্মদ লুৎফুল হক মনে করেন, রণদা ১৯১৭ সালের ২৫ আগস্ট জমাদার হিসেবে পদোন্নতি পান। অর্থাৎ জানুয়ারির আগেই পদোন্নতি না হলে আট মাসের মধ্যে নায়েক ও হাবিলদার পদ ডিঙিয়ে তার জমাদার হওয়ার কথা নয়। এ সময় বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির প্রধান ছিলেন এসজি টেলর। তিনি ১৯১৬ সালের ২০ নভেম্বরে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

যাহোক, বাঙালি পল্টনের নওশেরা ক্যাম্প শেষ হলো ১৯১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরে। এরপর তারা টেলরের নেতৃত্বে চলে যায় করাচি। ১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকেই তাদের করাচি বাস শুরু হলো। করাচি ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, ১৬ তম রাজপুত রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও বাদক দল টেলরের বাঙালি পল্টনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ব্যারাকে নিয়ে যায়। এখানে এসে প্রথমে তারা তাঁবুতে, তারপরে পাকা ব্যারাকের পাশে অবস্থিত তিনটি কাঁচা ব্যারাকে ঠাঁই পায়।

মনবাহাদুরের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভোর ৫টায় তারা কিছু জলযোগ করেই বন্দুক, শতরঞ্চি, নিশান (ফ্ল্যাগ), গুলির বাক্স প্রভৃতি কাঁধে নিয়ে ব্যারাক থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে মার্চ করে চাঁদমারীতে যেত। আবার মার্চ করে তারা ব্যারাকে ফিরত। এই সময় তারা মন-প্রাণ উজাড় করে একটি গান গাইতো। না ছিল তাতে আধ্যাত্মিকতা, না ছিল শিল্পের ব্যাকরণে উত্তীর্ণ কোনো জগৎখ্যাত শ্রেষ্ঠত্ব। তবু সে গানের প্রাণ আর আঁকুতি ছিল হৃদয় নিংড়ানো। সৈনিক বাঙালি বইতে গানটি এভাবে উল্লেখ আছে:

‘ক্যারাসিনের ত্যাল।

আহাগুন দিলে জ্বলে রে ভাই

ক্যারাসিনের ত্যাল।

দেখতে লাগে পানির লাহাল

আহাগুন দিলে জ্বলেরে ভাই

ক্যারাসিনের ত্যাল।

বাতের ব্যারাম হুলি পরে

মাহালিস করলে সারেরে ভাই

ক্যারাসিনের ত্যাল।’

মনবাহাদুরের কাছে এই গানের কাব্য সম্পদ ও ভাষামাধুর্য ছিল অমিয়। এ গান তাদের মার্চ করে পথচলার সময় কতই না আনন্দ দিত! তবে গান চলাকালে কুমার অধিক্রম মজুমদার তার লম্বা দুটি হাত দুলিয়ে গানের সঙ্গে সঙ্গে হোঃ হোঃ লেফট রাইট বলে চিৎকার করে উঠত।

এই করাচিতে তাদের খাবার কষ্ট কমে আসে বটে, দুবেলা ভাতের অভাব বাঙালিদের প্রাণ বিষিয়ে তোলে। এসএম লুৎফর রহমান লিখেছেন, ভোর ছ’টায় ছিল চা আর হালুয়া। ১১/১২টায় ভাত, ডাল আর তরকারি। রাত ৮-১০টায় রুটি-ডাল আর তরকারি। কোনো কোনো দিন তরকারির বদলে মাছ বা মাংস। আবার কোনো কোনো দিন লুচি, তরকারি আর হালুয়া। তখন করাচিতে সামুদ্রিক মাছের দাম ছিল আড়াই আনা থেকে সাত আনা। মাংস সেরপ্রতি পাঁচ আনা থেকে ছ’আনা। দুধ সেরপ্রতি দু’আনা। ঘৃতপক্ব ময়দার খাবার প্রতিসের চার আনা। রাবড়ি এক সের বারো আনা। আর তরকারির মধ্যে আলু, বেগুন ও কপি ছিল খুব সুলভ। এক সের গরম দুধ বা দইয়ের মূল্য ছিল তিন আনা।

সরকারই তাদের খোরাকি দিত। তবে পাচকের অভাবে মুসলিম সেপাইদের খুব কষ্ট পোহাতে হতো। একদিন সৈনিক মাহবুব-উল-আলমের ওপর রান্নার দায়িত্ব পড়ল। সঙ্গে জোনাব আলী। রান্না ৫০-৬০ জনের। মাহবুব-উল-আলম প্রকাণ্ডসব চুল্লির সামনে মোড়া পাতিয়ে রোমান্টিক ঢংয়ে বসে আছেন। এ সময় জোনাব আলী মেঝের ওপর উটের কয়েকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছড়ে ফেলে বলে উঠল, ‘নানা! এই গোশত নিয়ে আসলাম।’ এরপর মাহবুব-উল-আলম রান্নার দায়িত্ব নিলেন নিজে আর জোনাব আলীকে দিলেন বাকে করে জল আনার দায়। রান্নাটি অতি সহজ কাজই ভেবেছিলেন মাহবুব-উল-আমল। ‘চাল দিবে যত তত, জল দিবে সোয়া তত’ বাবার এই সূত্র মতে, মাহবুব-উল-আলম ভাত চড়িয়ে দিলেন। কিন্তু বিধি-বাম কিছুক্ষণ পরেই ঢাকনির তলায় ভ‚মিকম্প আরম্ভ হলো। ঢাকনি তুলতেই গরম জল চারদিক থেকে পর্বতের চ‚ড়ার মতো আর আধ-ফুটা চাল মাঝ বরাবর উতলে উঠতে লাগল। উপায়ান্তর না পেয়ে মাহবুব-উল-আলম জোনাব আলীকে তলব করলেন। জোনাব আলী এসে বলল, ‘তুমি শালা জানো আমারই সমান’। তখন মাহবুব-উল-আলমের ইচ্ছে হয়েছিল নানা জোনাব আলীকে বলবে, ‘তুই শালা কোনো দিন ডাল পাক করেছিস?’ কিন্তু তা না করে দুজনে মিলে বুদ্ধি আটলো। এরপর জোনাব আলীর মাথায় এক বুদ্ধি গজালো। তা দেখে মাহবুব সাব হতবাক! এই শিং ছাড়া ষাড়ের মতো মানুষটি কীভাবে এই চমৎকার বুদ্ধি বের করলা! গায়ে-গতরে বলদ সদৃশ, মাথায় তো বুদ্ধি ফাঁকা। যাহোক, জোনাব আলী ডেকচির ঢাকনা লাগিয়ে তার ওপর জ্বলন্ত অঙ্গার চাপিয়ে দিল স্তরে স্তরে। আর বলল, ‘নিচেও আগুন, উপরেও আগুন, এবার তোমার চাল ভাত না হইয়া পারে’! মাহবুব সাব জোনাব আলীর এই কর্ম দেখে খুশি হয়ে গেলেন। আর নিশ্চিন্ত মনে মাংসের হারাম রগ ছাড়াতে লাগলেন। এমন সময় ব্যারাকের বাইরে আওয়াজ হলো, squad halt! Left turn! Dismiss! তারপর কলরব। এই শুনে মাহবুব-উল-আলমের তো মাথায় হাত চিন্তায় পড়ে গেলেন, এখন উপায়? প্যারেড তো শেষ, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো এখনই তো সবাই স্নান সেরে খাবার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটবে!

এসব ভাবতে ভাবতে বেচারা মাহবুব চুলার দিকে তাকিয়ে দেখেন, মড়ার উপর খাড়ার ঘা!ডেকচির ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোনো শুরু হয়েছে। মানে চাল পুড়ে ছাই। উপর থেকেও পুড়ছে, নিচ থেকেও। আবার নিচ থেকে পোড়া চাল উপরের দিকে উগড়ে পড়ার জন্য কাঠ-কয়লায় চাপা ডেকচির নিচে লাভার মতো আছড়ে পড়ছে। কি আর করা! যে ভাতের আশায় তারা বসে আছে, তা কুত্রাপি ‘নৈব নৈব চ’। মাহবুব সাব রাগে ডগমগে হয়ে জোনাব আলীর দিকে তাকাতেই জোনাব আলী বলল, ‘তোমাকে যেমন কমিশনার সাহেব মেম সভা করিয়া বিদায় দিয়েছেন, আমাকেও তেমন স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সভা ডাকিয়া সম্মান দেখাইয়াছেন। বুঝলে কি না নানা! আমরা দুজনেই সমান।’

এদিকে ভুভুক্ষের দল খাবার জন্য দল বেঁধে ছুটেছে। যেন হামলে পড়ার মতো। হাতে থালা-বাটি। মাহবুব সাব একবার কী করবেন? ভয়ে ভয়ে হাতা নিয়ে দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলেন। সবকিছু তার কাছে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হলো। ছড়ানো-ছিটানো উটের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মেঝেতে, ওদিকে পুড়ে অঙ্গার চাল। সিদ্ধান্ত নিলেন মনে মনে, কিছু হলে বাক্য বিনিময় করবেন না, প্রয়োজনে হাতা ব্যবহার করবেন বিনা দ্বিধায়। কলরব করে সবাই ছুটে এলেন, এ সময় মীর ছালাম একবার চুলার দিকে আরেকবার হাতা-ধারী মাহবুব-উল-আলমের দিকে চাইলেন। তারপর অবস্থা বিলকুল পর্যবেক্ষণ করেই গর্জে উঠলেন, ‘মনিরুদ্দিন শালা কোথায়? এমন লোককে পাক করতে দিয়াছে’। বাঁচা-বাঁচ এই মীর ছালাম ছিলেন মাহবুব-উল-আলমের দলের লোক। তাই তার ওপর আর চড়াও হলেন না। সঙ্গে সঙ্গে দুজন এসে ভাতের হাঁড়ি উপুড় করে ফেলে দিল নর্দমায়। আরেকজন গোশতের হাঁড়ি কোপাতে লাগল। অবস্থা দাঁড়াল সবারই এখন পেটের ক্ষুধা আর খাবার জোগানো ওই তো নৈব নৈব চ। আগে যা এখনও তাই।

এমন নিত্য কষ্ট আর হতবাকি কাণ্ডের ভেতর দিয়ে তাদের দিনাতিপাত হতো। তবু সেনা ছাউনির প্রশিক্ষণ শিবিরে তাদের সফলতা ছিল ঈর্ষণীয়।

লেখক : গবেষক, শেয়ার বিজ

mshelleyjuÑgmail.com

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০