রহমত রহমান: রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত সিগারেট। এই খাত থেকে গত অর্থবছর প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা সরকার রাজস্ব পেয়েছে; যা পুরো রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ এবং ভ্যাট হতে পাওয়া রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ। তবে চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট বাজারজাত করা হচ্ছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, বাজারজাত করা সিগারেটের প্রায় ১০ শতাংশ চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যবহার করা সিগারেট, যাতে প্রতি বছর সরকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। মূলত নিন্মস্তরের সিগারেটে নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হচ্ছে।
নি¤œস্তরের সিগারেটে ক্রমাগত কর বাড়ার ফলে নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলের ব্যবহার করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এসব সিগারেট বাজারজাত করে আসছে। এছাড়া নিন্মস্তরের সিগারেটে কর বেড়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি হচ্ছে ব্যান্ডরোল ও সিগারেট। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দুইটি চালানে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার নকল ব্যান্ডরোল আটক করে। এর আগে আরও ১৩টি চালানে প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যান্ডরোল দেশে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলের ব্যবহার ও রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধে নিন্মস্তরের সিগারেটে কর বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে নিন্মমানের সিগারেট প্রত্যন্ত এলাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকেও অনেক কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেশি মুনাফার আশায় দেশে অবৈধ ব্যান্ডরোলের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। নিন্মস্তরের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের দাম সর্বনিন্ম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ টাকা, এতে সর্বমোট ৭৩ শতাংশ কর আদায় করে সরকার পায় ২৮ টাকা ৪৭ পয়সা। কিন্তু ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে কেউ যদি সিগারেট বাজারজাত করে, তাহলে বাজারজাতকারীর এই টাকার পুরোটাই লাভ।
তাদের হিসাব মতে, প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়। এ সুযোগে বেড়ে চলেছে অবৈধ সিগারেটের বাজার। কভিড মহামারির আগে এই ধরনের ১০ থেকে ১২টি ফ্যাক্টরি ছিল। এখন ধারণা করা যায়, এই সংখ্যা ২৫-এর ওপর। এই ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন করছে এবং বিক্রির জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল বেছে নিচ্ছে। কারণ সেখানে পুলিশ বা রাজস্ব কর্মকর্তাদের নজরদারি কম। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোক্তারা নিন্ম ও মধ্যমস্তরের ধূমপায়ী, তারা সিগারেট বৈধ না অবৈধ সেটি বুঝে না। কারণ অবৈধ সিগারেট ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে পুরোনো প্যাকেট থেকে ট্যাক্স স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহার করে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে সিগারেট বাজারজাত করে।
বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সিগারেটের মূল্য ও করহার গড়ে ৭৭ শতাংশ; যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কর আদায়ে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলের নকল ও অবৈধ ব্যবহারে প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। কিন্তু অসাধু উৎপাদনকারী বা ব্যবসায়ী সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে আমদানি করা অবৈধ ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এসব ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট বাজারজাত করায় কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারের মাধ্যমে নিন্মমানের সিগারেট বিক্রি করায় বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সরকার বছরে প্রায় ৮০০-১০০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার বিভিন্ন কারখানায় গোপনীয়ভাবে সিগারেট তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেয়া ব্র্যান্ডের সংখ্যা ৪০টি।
অন্যদিকে সিগারেট খাতের উদ্যোক্তাদের হিসাব অনুযায়ী, নিন্মস্লাযাবের সিগারেটের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে চোরাচালান, নকল ও ব্যবহƒত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট বানানোর প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। নিন্মস্লাযাবের সিগারেটের দাম ক্রমাগতভাবে বিগত বছরগুলোয় প্রায় ৬৪২ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শত কোটি টাকার সিগারেট ও নকল ব্যান্ডরোল দেশের বাজারে ঢুকছে। ফলশ্রুতিতে যথাযথভাবে রাজস্ব দিয়ে সামগ্রিক সিগারেট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর আগে যেখানে সিগারেটের বাজার ছিল বছরে ৮৪ থেকে ৮৫ বিলিয়ন শলাকা। সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭১ বিলিয়ন শলাকায় এসে দাঁড়ায় এবং বর্তমান অর্থবছর শেষে এর প্রাক্কলিত পরিমাণ প্রায় ৭১ বিলিয়ন শলাকা হতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে দেশের বাজারে চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছিল। সেটি একাধিকবার কর্তৃপক্ষের গোচরে আনলেও তা যথাযথভাবে আমলে নেয়া হয়নি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সিগারেট ও নকল ব্যান্ডরোল জব্দের পরই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এই থেকে স্পষ্ট ও প্রমাণিত হয় যে, বছরের পর বছর চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল দ্বারা সিগারেট উৎপাদন এবং বাজারজাত হয়ে আসছে।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশ সিগারেট চোরাচালান, নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে; যা আগে কখনোই ২ শতাংশের বেশি ছিল না। আর গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি নিন্মস্তরের সিগারেটের মূল্য প্রায় ৪০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং এতে করে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসা রমরমা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা নকল ব্যান্ডরোল, স্ট্যাম্পের দুইটি চালান ধরা পড়ে যাতে নিন্মস্তর ও মধ্যম স্তরের ব্যান্ডরোল ও স্ট্যাম্প ছিল। যার মাধ্যমে সরকারের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সম্ভব হতো। শুধু এক মাসে আটক করা জাল ব্যান্ডরোলের পরিমাণ বছর ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সম্ভব এবং যার মাধ্যমে আনুপাতিক হারে প্রায় ১০ বিলিয়ন শলাকা নিন্ম ও মধ্যম মানের সিগারেট প্রস্তুত ও বাজারজাত করা যায়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শুধু এনফোর্সমেন্টই যথেষ্ট নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ করনীতি এখানে সবচেয়ে জরুরি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে যখন নিন্ম ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের খুচরা পর্যায়ে মূল্য ৩ থেকে ৪ টাকা এবং ৫ থেকে ৭ টাকায় চলে যায় তখন থেকে বাজারে প্রচণ্ডভাবে অবৈধ সিগারেট আসা শুরু হয়। ওই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অযৌক্তিকভাবে মধ্যম স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তারা মধ্যম স্তর থেকে নিন্মস্তরে এবং কমদামি অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেহেতু নিন্মস্তরের কর আপাতন ওই সময়ে ৭১ শতাংশ ছিল এবং মধ্যম স্তরের কর আপাতন তখন থেকেই ৮১ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে এই দুই স্তরের প্রতি শলাকার মূল্য পার্থক্য ২ টাকা ছিল, ভোক্তারা সহজে তখন কমদামি ব্র্যান্ডে আগ্রহী হন এবং যার কিছু অংশ অবৈধ সিগারেট। সঠিক করনীতি প্রণয়ন করা হলে এই খাত থেকে রাজস্ব নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।