রাজস্ব ফাঁকির কৌশল

নকল ব্যান্ডরোলের সিগারেট যাচ্ছে ‘কুরিয়ারে’

রহমত রহমান: তামাক থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আসে। বিশেষ করে সিগারেট থেকে বেশি রাজস্ব আহরিত হয়। দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি সিগারেট বাজারজাত করার আগে ব্যান্ডরোল ক্রয়ের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধ করে। এ ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেটই বাজারজাত করে। কিন্তু একটি অসাধু চক্র রাজস্ব ফাঁকি দিতে দীর্ঘদিন ধরে নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট ও বিড়ি বাজারজাত করে আসছে। মূলত এ সিগারেট বাজারজাত করতে চক্রটি কুরিয়ার সার্ভিসকে বেছে নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক জেলার সিগারেট পাঠানো হয় অন্য জেলায়।

নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেটের কারণে একদিকে কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। প্রতিনিয়ত ভ্যাট কমিশনারেটগুলো নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট আটক করে আসছে। প্রাপকের ও প্রেরকের সঠিক ঠিকানা দেওয়া হয় না। ফলে নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট-বিড়ি আটক হলেও চক্রের মূল হোতাদের আটক করা যায় না। তবে কোম্পানির লোকজন জড়িত থাকায়, আর সঠিক ঠিকানা না থাকায় চক্রকে শনাক্ত করতে পারে না ভ্যাট কমিশনারেট।

সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে ভ্যাট কমিশনারেট সারা দেশে অভিযান ও নজরদারি জোরদার করেছে। আটক হচ্ছে একের পর এক চালান। বেশিরভাগ চালান কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আটক হচ্ছে। শুধু দেশি নয়, বহুজাতিক কোম্পানির ব্র্যান্ডের সিগারেটেও নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট দুটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে তিনটি চালানে সিগারেট আটক করেছে। এর মধ্যে রছেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেডের (বিএটি) ডারবি ব্র্যান্ডের সিগারেট, পার্টনার ব্র্যান্ড ও পূরবী ব্র্যান্ড। বিশেষ ক্ষমতা আইনে রোববার রাতে দুটি মামলা করা হয়েছে।

সহকারী কমিশনার মো. শাহ আলম বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন, যাতে উল্লেখ করা হয়, ৮ আগস্ট সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটের একটি প্রিভেন্টিভ দল নাইওরপুল পয়েন্টে এসএ পরিবহনে তল্লাশি চালায়। এ সময় ডারবি ব্র্যান্ডের পাঁচটি বস্তায় মোট ৫০ হাজার প্যাকেট বা এক লাখ শলাকা, প্রতি প্যাকেটের মূল্য ৭৪ টাকা করে তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া পূরবী ব্র্যান্ডের দুটি বস্তায় ৪০ হাজার প্যাকেট বা ৪০ হাজার শলাকা, প্রতি প্যাকেটের মূল্য ৩৯ টাকা করে মোট এক লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এসব সিগারেট জব্দ করা হয়। তিনটি মেমোতে প্রেরক এন্ড ব্রাদার্স, রাজশাহী, বাবু ভাই, আর প্রাপক হিসেবে কয়েকজনের নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকলেও ঠিকানা নেই।

এতে আরও বলা হয়, সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সংযুক্ত স্ট্যাম্পের ওপর হলোগ্রাম থাকে। স্ট্যাম্পের মধ্যে নীল রঙের শাপলা প্রিন্ট করা থাকে। ইউভি লাইট টর্চের আলো স্ট্যাম্পের হলোগ্রামের ওপর ফেলা হলে তাতে এনবিআর লেখা পাওয়া যায়। এনবিআর প্রিন্টটি হিডেন অবস্থায় থাকে। ইউভি লাইট ব্যতীত তা দেখা যায় না। স্ট্যাম্পটি পানিতে ভেজালে আসল স্ট্যাম্পের ওপর নীল রঙের শাপলার নীল কালি সহজেই পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং প্রিন্টটি আর দেখা যায় না। কিন্তু ডারবি ও পূরবী ব্র্যান্ডের সিগারেটের স্ট্যাম্প পানিতে দেওয়ার পর রং মিশে যায়নি। ইউভি লাইট দিয়ে দেখার পর এনবিআর লেখা দেখা যায়নি। এছাড়া আরও পরীক্ষার জন্য ব্যান্ডরোলের নমুনা গাজীপুর সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেডে পাঠানো হলে তারাও নকল বলে শনাক্ত করে। বহুজাতিক কোম্পানির সিগারেট নকল ব্যান্ডরোলে বাজারজাত করায় হতবাক কর্মকর্তারা। এ নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটজনকে আসামি করে মামলা করা হয়।

অপর মামলা একই কমিশনারেটে সহকারী রাজস্ব অনিক দে বাদী হয়ে দায়ের করেন, যাতে বিল্লাল নামের গাজীপুরের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। মামলায় বলা হয়, ২৬ জুন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রিভেন্টিভ টিম কুমারপাড়া এ জে আর পার্সেল অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসে তল্লাশি চালায়। এ সময় পার্টনার ব্র্যান্ডের ৯৯ কার্টনে ৪৯ হাজার ৫০০ প্যাকেট সিগারেট আটক করা হয়। প্রতি প্যাকেটে ২০ শলাকা হিসেবে মোট রয়েছে ৯ লাখ ৯০ হাজার শলাকা। প্রতি প্যাকেট ৭০ টাকা হিসেবে মোট মূল্য ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। প্রেরক হিসেবে গাজীপুর থেকে বিল্লাল ভাই ও একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। প্রাপক হিসেবে শিরিন স্টোর, সিলেট ও একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। ডারবি ও পূরবী ব্র্যান্ডের মতো পার্টনার ব্র্যান্ডের সিগারেটেরও ব্যান্ডরোল পরীক্ষা করে নকল বলে নিশ্চিত হয় কমিশনারেট। পরে মামলা করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানা দুটি মামলা গ্রহণ করেছে।

অপরদিকে সম্প্রতি কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কুমিল্লা, ফেনী ও চাঁদপুর থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট আটক করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সিগারেট কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আটক করা হয়েছে, যাতে প্রাপক ও প্রেরকের বিস্তারিত ঠিকানা দেওয়া নেই। এ নিয়ে মামলা ও অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটসহ সব ভ্যাট কমিশনারেট অভিযান চালাচ্ছে। যশোর ভ্যাট কমিশনারেট ২০১৯ সালে নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট বাজারজাত করার অপরাধে নতুন ভ্যাট আইনে প্রথম ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। বেশিরভাগ অভিযানে ব্র্যান্ডের সিগারেট আটক হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে কোম্পানির লোকজন সরাসরি জড়িত বলে ধারণা করছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা।

এনবিআর সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মো. জামাল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশব্যাপী অভিযান চলছে। সিগারেট ও বিড়ি সেক্টরে নকলবাজির মাত্রা ছাড়িয়েছে। এরা বাজার নষ্ট করছিল। ফলে এ খাতে রাজস্ব কমে যাচ্ছিল। যেটা আমাদের ভ্যাট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’

তিনি বলেন, ‘কমিশনারদের এসব নকলবাজি কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। কমিশনাররা রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশ মেনে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। তার সুফল আসা শুরু করেছে। আমরা ভালো ট্যাক্স পেয়ারদের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০