বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প নকশিকাঁথা। লোকসংস্কৃতি আর গ্রামীণ হস্তশিল্পের একটি বড় জায়গা দখল করে আছে নকশিকাঁথা। সুই-সুতার সুনিপুণ নকশায় অলঙ্কিত কাঁথাই নকশিকাঁথা। ১৯২৯ সালে জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর বাংলা ভাষায় নকশিকাঁথা শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। নকশিকাঁথার জমিন জুড়ে নানা রঙের বাহারি নকশা। বাংলায় দীর্ঘসময় ধরে চলে বর্ষাকাল। বর্ষায় ঘরের বাইরের কাজ কমে আসে নারীদের, একটুখানি অবসরের সন্ধান পায় তারা। বাঙালি নারীদের এই অবসর সময়ে কথপোকথন আর পান-সুপারির আড্ডায় সুই-সুতা হাতে কাঁথা সেলাই এক চিরাচরিত অভ্যাস। পল্লি রমণীদের শিল্পী মনের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি যেন নকশিকাঁথা। কোনো সময় কাঁথায় উঠে আসে লুকায়তি ভাবনা, কল্পনা, দুঃখ আর সুখের কাহিনি, মাছ, গাছ, পাখি, পাল্কি, লাঙল, নৌকা, হাতি, ফুল, লতাপাতা, ঘোড়া, চাঁদ-তারা, রাজ-রাজার জীবনকাহিনি, গ্রামীণ জীবনের চিত্র, কখনও লণ্ঠনের নিভু আলোয় শোনা পুঁথির গল্পই সুই দিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তুলেছেন নারীরা। ব্যবহারিক জীবনে নানা বিষয়বস্তুকে কাঁথা সেলাইয়ের এই কারিগররা আকর্ষণীয় প্রতীক ও রূপকের আদলে মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুঁটিয়ে তোলা বিভিন্ন ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি ঠাঁই দেন তাদের নকশিকাঁথায়।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরা জীবন-জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখছে। অনেকেই নকশিকাঁথা তৈরি করে দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে নকশিকাঁথা সেলাই করে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে এনে অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। এই শিল্প গ্রামীণ নারীদের আয়ের অন্যতম উৎসব। নি¤œবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সাহায্যে ভূমিকা রাখছে বেশ। শৈল্পিক ডিজাইনে প্রতিটি নকশিকাঁথা দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে। বর্তমানে নকশিকাঁথাগুলো দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে মন কেড়েছে বিদেশিদেরও। বিদেশে চাহিদা বাড়ছে নকশিকাঁথার। সালের বিবর্তনে এভাবেই তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাচীন হস্তনির্ভর দেশীয় কুটির শিল্প। ফলে প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি প্রণোদনা প্রদান, ব্যবসায়ী পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও সহযোগিতা। এছাড়া প্রয়োজন কুটিরশিল্প সম্প্রসারণের জন্য অপেক্ষিত সংরক্ষিত অভ্যন্তরীণ বাজার, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নকশা বহুমুখীকরণ, ঋণ সুবিধা, বাজারজাতকরণ ও বাজার প্রসারের বিশেষ পদক্ষেপ। নৈপুণ্য হস্তশিল্পীদের দৃষ্টি নন্দন এই নকশিকাঁথা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার।
তোফাজ্জল হোসেন
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়