আব্দুল হাকিম, রাজশাহী: নগরায়ণের অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজশাহীতে শব্দদূষণ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যানবাহনের হর্ন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার টিটি হর্ন এবং বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোয় অযথা উচ্চ শব্দের কারণে নগরবাসীকে নানা শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শ্রবণশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত ঘুম, এমনকি হার্টের সমস্যার ঝুঁকিও বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
রাজশাহীতে নগরায়ণের ফলে গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে শুরু করেছে। কিছু বছর ধরে শহরটিতে যত দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে, ততটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে শব্দদূষণের মাত্রা। বিশেষ করে ট্রাফিক এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং মিশ্র এলাকাগুলোয় শব্দের মাত্রা উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এমনকি নীরব এলাকার শান্তিও এখন শব্দের গোলযোগে বিঘ্নিত হচ্ছে। বাসিন্দাদের মধ্যে এখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জানান, কয়েক বছর ধরে শহরের শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে আমাদের এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল, কিন্তু এখন প্রতিদিনই গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজের শব্দ এবং নানা ধরনের কোলাহল সহ্য করতে হয়। এই শব্দের কারণে আমার পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিচ্ছে।
নগরীর তালাইমারি এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় মুদি দোকানদার শাহজাদা হোসেন বলেন, শান্তির নগরী রাজশাহী আমাদের কাছে যে স্বপ্নের মতো ছিল, এখন তা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আমরা যদি সবাই মিলে এই সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হই, তাহলে হয়তো কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের প্রথম এবং রাজশাহী বিশ্বের চতুর্থ শব্দদূষণকারী শহর হিসেবে দেখানো হয়। যেখানে রাজশাহীতে শব্দের পরিমাণ দেখানো হয় ১০৩ ডেসিবেল। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাজশাহী শহরের পাঁচটি জনবহুল স্থানে দিনের বেলা নগরীর ব্যস্ততম সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ২০২২ সালে এবং একই স্থানে ২০২৩ সালে শব্দের মান নির্ণয় করে। পরিবেশবান্ধব শহর রাজশাহীর পাঁচটি স্থান, তালাইমারী মোড়, রেলগেট, বিসিক মঠ পুকুর, লক্ষ্মীপুর মোড় ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় শব্দের মান নির্ণয় করা হয়।
বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে নগরীর রেলগেট ও লক্ষ্মীপুর মোড়ে শব্দদূষণের মাত্রা ছিল ৯০ ডেসিবেল, যা পুরো নগরীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৪ ডেসিবেল, বিসিক মোড় এলাকায় ৭৪ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৮৮ ডেসিবেল ছিল শব্দদূষণের মাত্রা। তবে এক বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে শব্দদূষণের মাত্রা নগরীর তালাইমারীতে ৮৬ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯০ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭২ ডেসিবেল, লক্ষ্মীপুর মোড়ে ৮৯ ডেসিবেল ও সাহেব বাজারে জিরো পয়েন্টে ৮৭ ডেসিবেল পাওয়া যায়। দিনের চেয়ে রাতেও শব্দদূষণের মাত্রা খুব একটা কম নয় বলেও পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে।
সবশেষ ২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৮ দশমিক ৮ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯৬ দশমিক ৩ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭৬ ডেসিবেল, লক্ষ্মীপুর মোড়ে ৯৬ দশমিক ১ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৯০ দশমিক ৫ ডেসিবেল পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকৌশলী ড. জাকির হোসেন খান বলেন, অধিকাংশ যানবাহন অযথা হর্ন বাজাতে থাকে। বর্তমানে রাজশাহীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশা বিদ্যমান, যেগুলো মূলত টিটি হর্ন ব্যবহার করে। নগরীর তালাইমারী ও রেলগেটে বাসগুলোকে অযথা হর্ন বাজাতে দেখা যায়। অটোরিকশায় ভেপু হর্ন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেন অন্য কোনো হর্ন ব্যবহার করতে না পারে। এছাড়া অটোরিকশা আর রিকশা নির্দিষ্ট লেনে দাঁড়ালে অহেতুক হর্ন দেয়া অনেকাংশেই কমে যাবে।
তিনি বলেন, শহরের মধ্যে গতিসীমা নির্দিষ্ট করলে এর পরোক্ষ প্রভাব শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ওপর পড়বে। শব্দদূষণের প্রভাব শুধু মানুষের উপর নয়, প্রতিটি পশুপাখির ওপর পড়ে। গাছ শব্দের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যথেষ্ট কার্যকর। আমের শহর রাজশাহীতে আম-জামজাতীয় ফলের গাছ, নিম ও সজনেজাতীয় উপকারী গাছ লাগানো যেতে পারে, যেগুলো বড় হলে শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সজনে গাছ বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন নির্গমনে কার্যকর গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এসব গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা গেলে অনেকটাই কার্যকর হতে পারে।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. এএসএম ইকবাল হোসাইন সাঈদ বলেন, উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ কানের শ্রবণ ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় এই অবস্থায় থাকলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা থেকে বাঁচতে হলে রাস্তায় গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নগুলো কমাতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষকে এটির সমাধান করতে হবে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানিয়েছেন, শহরে শব্দের মাত্রা সত্যিই বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে শহরের লাল-সবুজ অটোরিকশাগুলো একত্রে চলাফেরা করতে গিয়ে শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলছে। একইসঙ্গে মহানগরের বাইরের অটোরিকশাগুলোও শহরে প্রবেশ করছে। যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই শব্দের মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
এছাড়া অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। এ কারণে আমাদের শান্তিপূর্ণ নগরীতে শব্দদূষণের প্রবণতা বাড়ছে। শব্দদূষণ প্রতিরোধের জন্য আমরা ব্যাপক প্রচারাভিযানের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবৈধ যানবাহনের মালিকদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছি। আশঙ্কাজনকভাবে নীরব এলাকাগুলোয় শব্দদূষণের সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
ড. হুমায়ূন কবীর বলেন, আমরা এরই মধ্যে অভিযানে নেমেছি। অতিরিক্ত হর্ন বাজানো হলে প্রথমে চালকদের সতর্ক করা হচ্ছে এবং এর পরের ধাপে তাদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, প্রত্যেকের উচিত নিজেদের দায়িত্ব সচেতনভাবে পালন করা। প্রায় ২০-২৫ দিন আগে থেকেই রাজশাহীর রাস্তায় দুই শিফটে চলাচলকারী অটোগুলোকে আলাদা করা হয়েছে। শুধু শুক্রবার দুই শিফটের অটো একসঙ্গে চলে এবং এর বাইরে কেউ যদি এই নিয়ম ভঙ্গ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হয়।