ড. মতিউর রহমান :বাংলাদেশ আবারও এক ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে; যা ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের উজান থেকে আসা পানির স্রোতের ফলে আরও তীব্র হয়েছে। বন্যায় এখনও দেশের ১১টি জেলায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮। এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৮ জনের মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নিখোঁজ আছেন দুজন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ-সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনে গতকাল রোববার এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বেলা ৩টায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রামে পাঁচজন, কুমিল্লায় চার, নোয়াখালীতে তিন, কক্সবাজারে তিন, ফেনীতে এক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক ও লক্ষ্মীপুরে একজন। এ ছাড়া নিখোঁজ দুজন মৌলভীবাজারের। প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলাগুলোয় ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন ৪ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, চিকিৎসা দল এবং অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফেনীতে ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যোগাযোগের জন্য ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি ভি-স্যাট (ভেরি স্মল অ্যাপারচার টার্মিনাল) চালু করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু মানবজীবনকে অবরুদ্ধ করেনি, বরং অর্ধকোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ও কল্যাণকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বন্যার ব্যাপকতা অত্যন্ত গভীর। বন্যার্ত মানুষগুলো তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা এবং মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্লাবিত এলাকাগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা মৌলিক সেবাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী একদিকে প্রিয়জন হারানোর শোক নিয়ে রয়েছে, অন্যদিকে জীবিকা পুনর্গঠনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় বিপুল মানুষ আশ্রয় নেয়ায় কেন্দ্রগুলোয় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং পর্যাপ্ত সম্পদের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সরকার বন্যাপীড়িতদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার মেডিকেল টিম মোতায়েন করেছে। এই টিমগুলো আহতদের চিকিৎসা, পানিবাহিত রোগের বিস্তার রোধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে নিরলস কাজ করছে। তবে পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে স্থানীয় সম্পদের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরিস্থিতি এখনও গুরুতর।
বন্যায় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কারণ ফসল এবং গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে গেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছেন।
সেনাবাহিনী ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে এবং খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করছে। তবে পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে এই প্রচেষ্টা এখনও অপর্যাপ্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানটি বন্যার্তদের জন্য খাদ্য, পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে সহায়ক হচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করছেন। তারা বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করছেন।
এই কার্যক্রমটি শুধু ত্রাণ সংগ্রহই নয়, বরং বন্যার্তদের জন্য একটি নৈতিক সমর্থন এবং সহযোগিতার বার্তা প্রদান করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে এই সংকটকালে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতা প্রদর্শন করছেন, যা প্রশংসনীয়। তাদের এই প্রচেষ্টা বন্যার্তদের সহায়তার পাশাপাশি, সমাজের অন্যান্য অংশকে সংকট মোকাবিলায় আরও সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করবে।
বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দলগুলোও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এই সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব সম্পদ, ক্ষমতা এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। তারা ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ এবং সংকটকালীন সময়ে সহায়তা প্রদান করতে পার্টি কর্মী এবং সমর্থকদের সন্তুষ্ট করছে। বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা নিজে মাঠে নেমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং বন্যার্তদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করছেন।
সামাজিক সংগঠনগুলোও বন্যার্তদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই সংগঠনগুলো তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছে। ত্রাণ সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরনের জরুরি সামগ্রী যেমন খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং পানির ব্যবস্থা করছে এবং তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এই সংকটকালে তাদের অনন্য অবদান রেখেছে। তারা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও শিল্পকলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এই তহবিল বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ব্যবহার করছে। কিছু সাংস্কৃতিক দল তাদের শিল্পকলা ও কর্মসূচির মাধ্যমে বন্যার্তদের জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করছে এবং জনসাধারণকে সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছে।
এই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দলগুলোর প্রচেষ্টা বন্যার্তদের সহায়তায় একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তুলেছে, যা সংকটের মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী ও কার্যকরীভাবে সহায়তা প্রদান করছে। তাদের সহযোগিতা বন্যার্তদের জীবনযাত্রা উন্নত করার পাশাপাশি, সমাজে একটি একতার বার্তা প্রচার করছে। বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা নিজেরা কিছু পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করছেন, যাদের সহায়তার ফলে অনেক বন্যার্তের খাবারের অভাব মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। তারা বন্যার্তদের জন্য খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করছেন। কিছু সংস্থা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করছে।
এই প্রচেষ্টা বন্যার্তদের জন্য অমূল্য সহায়তা প্রদান করছে এবং তাদের সংকটের সময়ে সাহসিকতা ও সহানুভূতির পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা চলমান সংকটের পূর্ণাঙ্গ সমাধান নয়। এজন্য সরকারের পাশাপাশি এসব সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের অব্যাহত সহযোগিতা এবং সংকট মোকাবিলায় একত্র প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এই বন্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি আবারও প্রকাশ করেছে। একটি নিম্নভূমি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে, বিশেষত বর্ষাকালে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বন্যা ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তবুও এই দুর্যোগের পরিসর ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ফাঁকফোকরগুলোকে প্রকাশ করেছে।
এই বন্যার পর পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জীবিকা পুনরুদ্ধার এবং সম্প্রদায়গুলোকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের এই সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করার ওপর নতুন করে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। এর জন্য প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত করা, অবকাঠামো শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে দুর্যোগের প্রতিক্রিয়ার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় এবং অনিয়ন্ত্রিত ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোর সমাধান করতে হবে, যা দেশের বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
আগস্ট ২০২৪-এর এই ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশের জন্য এক গভীর বাস্তবতা হিসেবে কাজ করেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায়, ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে তোলার এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে। তবে এটি সরকারের, নাগরিক সমাজের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করছে। সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বন্যার ক্ষতি কমাতে এবং এর জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে সক্ষম হবে।